এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এর মধ্যে রয়েছে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়, নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠনসহ পাঁচটি প্রধান ইস্যু।
এগুলো মোকাবেলার ওপর দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকাংশে নির্ভর করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এসব দাবি-দাওয়া না মেনে সরকার ফের একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপিকে তা মোকাবেলা করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জন করতে হবে তাদের। শুধু তাই নয়, এসব ইস্যুতে দেশি-বিদেশি শক্তির সমর্থন আদায়ের চ্যালেঞ্জও রয়েছে দলটির সামনে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সমঝোতা হলেও ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামার জন্য রয়েছে আরও দুটি চ্যালেঞ্জ। এগুলো হচ্ছে- এক. অল্প সময়ের মধ্যে ২০ দলীয় জোট ও বৃহত্তর ঐক্যের (প্রক্রিয়াধীন) শরিকদের মধ্যে তিনশ’ আসন সুষ্ঠুভাবে ভাগাভাগি করে প্রার্থী চূড়ান্ত। দুই. দলের চেয়ারপারসনসহ সিনিয়র নেতাদের নামে অসংখ্য মামলা মোকাবেলা।
এগুলো ছাড়াও দলটির নেতাদের মধ্যকার ঐক্য ধরে রাখাও যেমন কঠিন, তেমনি ধৈর্য ধরে পরিস্থিতি মোকাবেলা করাও দলটির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, নানামুখী চ্যালেঞ্জ থাকলেও আপাতত দুটি চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছেন তারা। নির্বাচনের আগে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও তার নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে বাধ্য করা। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা সফল করতে চলছে নানা তৎপরতা।
এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে এত অল্প সময়ে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে নেতাকর্মীরা নানা আলোচনা করছেন। সম্প্রতি তৃণমূলের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময়কালে দলটির সামনে কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে এবং তা মোকাবেলার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তার নেতৃত্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষেই মত দেন তারা। এ দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আন্দোলনের বিকল্প নেই বলে মনে করছে তৃণমূল। সেই আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতার লক্ষ্যে সাংগঠনিক শক্তি বিশেষ করে ঢাকা মহানগরকে সক্রিয় করার ওপর জোর দেয়া হয়।
তারা আরও জানান, আমাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও মূলত দুটি চ্যালেঞ্জকেই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। এ দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব হলে বাকিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমানে বিএনপিকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সরকার দেশে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু করেছে, যা কার্যত বাকশাল। তিনি বলেন, এ শাসনকে আরও দীর্ঘায়িত করতে আবারও একতরফা একটি নির্বাচন করার পাঁয়তারা করছে সরকার। আমাদের চেয়ারপারসনকে বিনা দোষে কারা অন্তরীণ করে রেখেছে। কিন্তু খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি ও নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। জনগণ তা মেনে নেবে না। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিএনপি বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে এতে সন্দেহ নেই। দলটির চেয়ারপারসন দীর্ঘদিন ধরে কারা অন্তরীণ। তার জামিন আটকে যাওয়ায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশাও সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, দলটির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকলেও এ মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা বিএনপির মূল চ্যালেঞ্জ। এ দুটি ছাড়াও আরও বেশকিছু চ্যালেঞ্জ দলটির সামনে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে না পারলে ভবিষ্যতে দলটিকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে বাকি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা দলটির জন্য ততটা কঠিন হবে না। কারণ প্রার্থী বাছাই, ইশতেহার তৈরিসহ নির্বাচনী অনেক কর্মকাণ্ডই তারা গুছিয়ে এনেছে। এদিকে উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়াকে কোনো মামলায় জামিন দেয়া হলেও দেখা যায়, অন্য মামলায় তার জামিন আটকে যায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করছেন নির্বাচনের আগে আইনি প্রক্রিয়ায় তার জামিন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
সেক্ষেত্রে করণীয় চূড়ান্তে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের মতামত নেয়া হয়। সবাই আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি রাজপথে সক্রিয় হওয়ার পক্ষে মত দেন। রাজপথে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হলে নির্বাচনের আগে চেয়ারপারসন মুক্তি পাবেন বলে বিশ্বাস তাদের। তাই খালেদা জিয়া ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে দলটির বেশির ভাগ নেতাকর্মী। এমন পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে এগোচ্ছে দলটি। সেই লক্ষ্যে নেয়া হচ্ছে কর্মপরিকল্পনা।
চেয়ারপারসনের মুক্তির পাশাপাশি সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি আদায়ের মতো চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হবে তাদের। কারণ সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, বর্তমান সংবিধান অনুসারেই নির্বাচন হবে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই তাদের নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে বলে ভরসা পাচ্ছেন না তারা।
বিশেষ করে বর্তমান নির্বাচন কমিশন তাদের নিরপেক্ষতা প্রমাণে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) মন্তব্যে আরও শঙ্কিত তারা। সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না এমন নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বৃহত্তর ঐক্যের দিকে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে সক্রিয় হতে পারলে দাবি আদায় করা সম্ভব হবে। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে সব দলকে নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলতে পারবে কিনা সেই শঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, চেয়ারপারসনের মুক্তিকেই আমরা মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। তাকে নিয়েই আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। তবে সেই নির্বাচন হতে হবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে।
বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রতীক। তাকে ছাড়া এদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। তাকে মুক্ত করেই আমরা নির্বাচনে যেতে চাই। তৃণমূল থেকে এমন মতামতই দেয়া হয়েছে। চেয়ারপারসনের মুক্তিসহ যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দলের নেতাকর্মীরা মামলা আর জেলের ভয় করে না। তৃণমূলের সেই সক্ষমতা রয়েছে। শুধু তৃণমূল নয়, সব পর্যায়ের নেতাদেরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে।
জানতে চাইলে মুন্সীগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান রতন বলেন, নেত্রীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হবে না। আন্দোলনের জন্য যে কোনো নির্দেশ সফলে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।