এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সরকারের নির্দেশনার পরও বেসরকারি বেশির ভাগ ব্যাংকই ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনেনি। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক সীমিত কয়েকটি খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনলেও বাকি ব্যাংকগুলো জোরালো কোনো পদক্ষেপও নেয়নি।
তারা ঋণের সুদহার আগের চেয়ে সামান্য কমিয়ে ডাবল ডিজিটেই রেখেছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সরকারি খাতের ৬টি, বেসরকারি খাতের একটি মাত্র ব্যাংক বেশির ভাগ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
ঋণের সুদহার সিঙ্গেল জিডিটে নামিয়ে আনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উদ্যোক্তা পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) নির্দেশনা রয়েছে। একাধিকবার বৈঠক করে তারা ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের নির্দেশনাও দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও চূড়ান্তভাবে উপেক্ষিত হল। এ বিষয়ে ব্যাংকের মালিক পক্ষ ও শীর্ষ নির্বাহীরা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। বিএবি’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটি ব্যাংকের এমডিরা বাস্তবায়ন করবেন। এদিকে এমডিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি নীতিনির্ধারণীর অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে এমডিরা কিছুই করতে পারবেন না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে। পর্ষদ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলে কার্যকর হচ্ছে না।
প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে- ব্যাংকের নির্বাহীরা ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়ে পর্র্ষদে প্রস্তাব পাঠাবে। পর্ষদ সেটি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। সব ব্যাংকেরই পর্ষদের বৈঠকের কার্যবিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো বিভিন্ন ব্যাংকের পর্ষদের কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সব ব্যাংকের পর্ষদেই ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এর ভিত্তিতেই সুদহার কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যাপারে বেশির ভাগ ব্যাংকের নির্বাহী ও পর্ষদ সদস্যরা বিরোধিতা করেছেন। বলেছেন, এখনই ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে না। সময় নিয়ে করতে হবে। এটা করার আগে ৬ শতাংশ সুদে আমানত পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সিদ্ধান্ত থাকার পরও এখন পর্যন্ত সরকারি আমানত ৬ শতাংশ সুদে বেসরকারি ব্যাংকগুলো পাচ্ছে না।
এ বিষয়ে বিএবি ও এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে শুধু এটাই জানি, কিন্তু এমডিরা বাস্তবায়ন করেছেন কিনা তা জানি না।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ঢাকা ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ৯ আগস্ট থেকে ঘোষিত সুদহার সব ব্যাংকের কার্যকর করার কথা। যদি কেউ না করে থাকে তবে সেটা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বোর্ড জানে।
এদিকে কোনো কোনো ব্যাংক কিছু খাতের ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামালেও ঋণের বিপরীতে নানা ধরনের ফি ও কমিশন আরোপ করে রেখেছে। এগুলোর কারণে গড় সুদের হার ডাবল ডিজিটেই থেকে যাচ্ছে। ফলে ঋণের সুদহার কার্যকরভাবে সিঙ্গেল ডিজিটে নামছে না। ফলে সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষিতই থেকে গেল।
সূত্র জানায়, ঋণের সুদহার কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে ১৪ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় তিনি ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। ওই সভায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদ উপস্থিত ছিলেন। তাকে উদ্দেশ করেই প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে বলা হয় বাংলাদেশ ব্যাংককে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা বিচার-বিশ্লেষণ ও ব্যাংকের এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করে এই হার কমানোর উদ্যোগ নেয়। এর আলোকে ২০ জুন বিএবি’র সভায় সব ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে এবং আমানতের সুদ হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা জানায়। কিন্তু ১ জুলাই থেকে সরকারি ৪ ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই কার্যকর করেনি। এক মাসেও সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কার্যকর না হওয়ায় ২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৈঠক ডাকেন। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় ওই বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থসচিব, সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং এমডিরা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘আজ (২ আগস্ট) প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, আমানতের সুদহার ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ ৯ আগস্ট থেকে কার্যকর করতে হবে। এদিনও তা কার্যকর হল না।
এদিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ওয়েস্টিন হোটেলে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আবারও বলেছেন, ৯ আগস্ট থেকে ঋণে ৯ এবং আমানতে ৬ শতাংশ সুদহার কার্যকরের যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তা প্রত্যেক ব্যাংককে অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৯ আগস্ট থেকে সুদহার কার্যকর শুরু হয়েছে। কে কতটুকু কার্যকর করল, তা জানতে কয়েকদিন সময় দিতে হবে।
সূত্র জানায়, সরকারি খাতের সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বাংলাদেশ কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক বেশির ভাগ ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে নানা ফি ও চার্জ আরোপিত থাকায় সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণের খরচ কমপক্ষে ১ থেকে দেড় শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারি বেসিক ব্যাংক গত এপ্রিলে আমানতের সুদহার কমালেও ঋণের সুদের হার কমায়নি। তাদের প্রায় সব ঋণেরই সুদের হার ১০ থেকে ১৩ শতাংশ।
একমাত্র আইএফআইসি ব্যাংক প্রায় সব ধরনের ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশে নামিয়েছে। এছাড়া আরও ৩৪টি ব্যাংক ঋণের সুদহার কমিয়েছে। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকেই এই হার ডাবল ডিজিটেই রেখেছে। এখন পর্যন্ত পূবালী, উত্তরা, প্রাইম, ব্র্যাক, ঢাকা ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, এনসিসি, ট্রাস্ট ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক শিল্প ঋণ, চলতি মূলধন ঋণের সুদহার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু অন্যান্য ঋণের সুদহার ১০ থেকে ১৬ শতাংশে রেখেছে। এছাড়া এবি, আল-আরাফাহ্, সিটি, এশিয়া, ইস্টার্ন, প্রিমিয়ার, মার্কেন্টাইল ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংক ঋণের সুদহার কমালেও তারা প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই হার ডাবল ডিজিটে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের মেঘনা, মধুমতি, এনআরবি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক ঋণের সুরহার সামান্য কমিয়ে ডাবল ডিজিটেই রেখেছে।
বেসরকারি ব্যাংকগুলো এখন পর্যন্ত যেসব ঋণের সুদহার কমিয়েছে সেগুলোর মধ্যে কেবল কৃষিঋণ, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ, রফতানি ঋণ ও মসলা চাষে ঋণের সুদের হার ৯ শতাংশের মধ্যে রেখেছে। এগুলোর সুদহার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া। একই সঙ্গে এগুলো আগে থেকেই কার্যকর। কিন্তু ব্যাংকগুলো এসব ঋণের সুদহার নতুন করে কমানোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কৃষি ও নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ ৯ শতাংশ, রফতানি ঋণ ৭ শতাংশ ও মসলা চাষের ঋণ ৪ শতাংশ সুদে বিতরণ করতে হবে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তহবিল থেকে যেসব ঋণ বিতরণ করা হবে সেগুলোর সুদহার হবে ১০ শতাংশ। এবি, প্রাইম, এনসিসি, ঢাকা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক শিল্প ঋণের সুদের হার কমিয়ে ৯ থেকে ১১ শতাংশে রেখেছে। চলতি মূলধন ঋণের সুদহার তারা ৯ থেকে ১৩ শতাংশে রেখেছে। আমদানি, খাদ্যপণ্য আমদানি ঋণের সুদহার ১০ থেকে ১৪ শতাংশ, হাউজিং খাতে ১০ থেকে ১৩ শতাংশ, ভোক্তাঋণে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ সুদহার রেখেছে। বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংকই এখনও শিল্প খাতের মেয়াদি ঋণ, চলতি মূলধন ঋণ, পণ্য আমদানি ঋণের সুদহার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রেখেছে। মাঝারি শিল্পে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্পে সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ। ভোক্তাঋণ ১৩ থেকে ১৭ শতাংশ, রফতানিমুখী শিল্প স্থাপনে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ রেখেছে। ওয়ান ব্যাংক ৯ আগস্ট থেকে আমানতের সুদহার কমিয়েছে। অচিরেই তারা ঋণের সুদহার কমাবে বলে জানা গেছে। এনআরবি ব্যাংক ৮ আগস্ট থেকে আমানতের সুদহার কমিয়েছে। ঋণের সুদহারও অচিরেই কমাবে। মানি লন্ডারিংয়ের ওপর থাইল্যান্ডের ব্যাংককে একটি কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন দেশের ২৬টি ব্যাংকের এমডি। তারা দেশে ফিরে এলে এ ব্যাপারে আরও অগ্রগতি হবে বলে জানা গেছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল হালিম চৌধুরী বলেন, ঋণের সুদহার কমতে শুরু করেছে। ভালো গ্রাহকদের ৯ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশে ঋণ দেয়া হচ্ছে। বেশকিছু গ্রাহককে বুঝিয়ে-শুনিয়ে ঋণের সুদহার ১১ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে এনেছি। পর্যায়ক্রমে আরও কমানো হবে।
উদ্যোক্তারা জানান, দেশে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ঋণের সুদহার কমানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হচ্ছে না। এতে উদ্যোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। তারা চড়া সুদের কারণে ঋণ নিয়ে শিল্প স্থাপন করতে পারছেন না। ফলে পুঁজি বিনিয়োগ না করে হাত গুটিয়ে বসে আছেন। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিল্পের বিকাশ ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ।