এশিয়ান বাংলা, সিলেট : সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচনে আবারও বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে ৬ হাজার ১৯৬ ভোটে হারিয়ে তিনি সিলেটের নগরপিতা নির্বাচিত হন। ২০১৩ সালে ৩৫ হাজার ভোটের ব্যবধানে কামরানকে হারিয়ে প্রথম মেয়র হয়েছিলেন আরিফ।
সিসিকের সব কটি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ২ লাখ ১ হাজার ৪৮৭টি। এর মধ্যে বৈধ ভোট ১ লাখ ৯৪ হাজার ৩। বাতিল হয়েছে ৭ হাজার ৪৮৪। বৈধ ভোটের মধ্যে আরিফুল হক চৌধুরীর প্রাপ্ত ভোট ৯২ হাজার ৫৮৮টি। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান পেয়েছেন ৮৬ হাজার ৩৯২টি। মহানগর জামায়াতের আমীর স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের পেয়েছেন ১১ হাজার ভোট। ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন খান পান ২ হাজার ২০৮ ভোট। সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের মো. আবু জাফর পান ৯০৯ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. বদরুজ্জামান সেলিম পান ৫৯২ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. এহসানুল হক তাহের পেয়েছেন ৩১৪ ভোট। মেয়র পদে দুই শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী কামরান ও আরিফ নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে নবনির্বাচিত মেয়র প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, জনগণের রায় কোনোভাবেই ছিনিয়ে নেয়া যায় না। অপরদিকে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেছেন, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ইসি প্রমাণ করেছে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব।
শনিবার স্থগিত হওয়া দুটি কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষে আরিফুল হক চৌধুরীকে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। এর আগে মোট কেন্দ্র ১৩৪টির মধ্যে অনিয়মের অভিযোগে স্থগিত হওয়া নগরীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী বোরহান উদ্দিন গরম দেওয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে এদিন ভোট গ্রহণ হয়। ভোট গ্রহণ শেষে গণনার পর আরিফের বিজয়ের বিষয়টি নিশ্চিত হয়। গাজী বোরহান উদ্দিন গরম দেওয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে মোট ভোটার ছিলেন ২২২১ জন। এর মধ্যে ভোট পড়েছে ১৩১২টি। তার মধ্যে আরিফ পেয়েছেন ১০৪৪ ভোট, নৌকার কামরান পেয়েছেন ১৭৩ ভোট। হবিনন্দী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষে আরিফ পেয়েছেন ১০৫৩ ভোট, নৌকায় কামরান পেয়েছেন ৩৫৪ ভোট। এ দুই কেন্দ্রের মোট ৪৭৮৭ ভোটের মধ্যে আরিফ পেয়েছেন ২০৯৭ ভোট। এর ফলে সব মিলিয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর চেয়ে ৬ হাজার ১৯৬ ভোট বেশি পান আরিফ।
নির্বাচনের বিষয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান বলেন, পুনঃভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।’
৩০ জুলাই সিসিকের চতুর্থ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ১৩৪টি কেন্দ্রের মধ্যে অনিয়মের কারণে দুটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছিল। বাকি ১৩২টি কেন্দ্রে কামরানের চেয়ে ৪৬২৬ ভোটে এগিয়ে ছিলেন আরিফ। তবে স্থগিতকৃত কেন্দ্র দুটির ভোট ৪৭৮৭টি হওয়ায় আরিফকে বিজয়ী ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন।
সন্তুষ্ট আরিফ-কামরান : সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নির্বাচনে বিজয়ী মেয়র প্রার্থী বিএনপির ধানের শীষের আরিফুল হক চৌধুরী ও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। আরিফুল হক চৌধুরী বলেছেন, জনগণের রায় কোনোভাবেই ছিনিয়ে নেয়া যায় না। জনগণ প্রমাণ করেছে কোনো ষড়যন্ত্রই সিলেটে কার্যকর হয় না। শনিবার গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে এমন মন্তব্য করেন তিনি। নির্বাচিত হওয়ার পর সবাইকে নিয়ে কাজ করে সিলেটকে আদর্শ নগরী হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আরিফ।
অন্যদিকে বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রমাণ করেছে তাদের দ্বারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন সফল। ভোট গ্রহণ পরিদর্শনকালে তিনি আরও বলেন, কোনো অনিয়ম নেই। কোনো সংঘর্ষ নেই। ভোটাররা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট কেন্দ্রে এসে নিজেদের রায় দিচ্ছেন। এ জন্য আমি নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই।
এদিকে সন্ধ্যায় বদরউদ্দিন আহমদ কামরান কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, সিলেট নগরীর যে কোনো প্রয়োজনে তিনি অতীতের ন্যায় সব সময় পাশে থাকবেন। এ ছাড়া উৎসবমুখর পরিবেশে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করায় সিলেট বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, নগরীর সক নাগরিককে ধন্যবাদ জানান। পাশাপাশি নির্বাচনের শুরু থেকে নৌকা মার্কার বিজয়ের লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, অঙ্গসংগঠনের সব নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানিয়ে সব সময় তাদের পাশে থাকার ও পাশে পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন কামরান। সিলেটসহ দেশের সব ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ার সাংবাদিকদেরও ধন্যবাদ জানান তিনি।
অপর ১৪ কেন্দ্রে নজিরবিহীন অনুপস্থিতি : এদিন ৫ কাউন্সিলরের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্নে ওই দুই কেন্দ্রসহ মোট ১৬টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সিসিকের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রাপ্ত ভোট সমান হওয়ায় বাকি ১৪টি কেন্দ্রে শুধু সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হয়। এসব কেন্দ্রে ভোটারদের অনুপস্থিতি ছিল নজিরবিহীন। সিলেটের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনো নির্বাচনে অতীতে এত কম ভোটার উপস্থিতি ছিল না। মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ ভোট পড়ে। ৩৪ হাজার ১২৩ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দেন মাত্র ৪ হাজার ৩১০ জন। এর মধ্যে সংরক্ষিত ৭নং ওয়ার্ডে ৩৩৩৭ ভোট পেয়ে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন নাজনীন আক্তার কনা (জিপ গাড়ি)। অপর প্রার্থী নার্গিস সুলতানা রুমি পান (চশমা) ৯৭৩ ভোট। ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তারা দু’জনই পেয়েছিলেন ৪১৫৫ ভোট। ভোট গ্রহণ চলাকালে এসব কেন্দ্রে সরজমিন দেখা যায়, ভোট কেন্দ্রের বাইরে ও ভেতরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রাখে পুলিশ, বিজিবি, আর্মড পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। ভেতরে ভোটার না থাকায় অলস সময় পার করছেন কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং অফিসার থেকে শুরু করে প্রায় সবাই। সিলেটে ভোট গ্রহণ শুরুর আগে থেকেই বৃষ্টি শুরু হওয়ায় প্রথম এক ঘণ্টা বেশিরভাগ কেন্দ্র ছিল ভোটার শূন্য। সকাল সাড়ে ১০টায় ২৪নং ওয়ার্ডের গাজী বোরহানউদ্দিন গরম দেওয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, দু-তিনজন ভোটার বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভোট দিতে এসেছেন। এ সময় ওই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা আরও তিনজনকে সন্দেহ হয় পুলিশের। তারা নিজেদের মা-বাবার নামই বলতে পারেনি। এই তিনজন হল : শামীম, মিনহাজ ও সাইদুল। তাদের আটক করে রাখা হয়েছে জানিয়ে কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার কৃপেশ রঞ্জন দাস যুগান্তরকে বলেন, তারা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে পারলে ভোট দিতে পারবেন। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বেলা সাড়ে ১১টায় ২৭নং ওয়ার্ডের হবিনন্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে পুরুষের তুলনায় নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বাকি ১৪টি কেন্দ্রের মধ্যে নগরীর কালাসীল এলাকার চান্দুশাহ জামেয়া ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কেন্দ্রের ৮টি বুথের সব কটিই ফাঁকা। ভোটার না থাকায় অলস সময় পার করছেন কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ কেন্দ্রেরও একই অবস্থা। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার ফিরোজ আল মামুন জানান, দুই হাজার ৩শ’ ১০টি ভোটের মধ্যে বেলা দেড়টা পর্যন্ত মাত্র ২৮৫টি ভোট পড়েছে। ভোটারদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, শুধু সংরক্ষিত ওয়ার্ডের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে নির্বাচন হওয়ায় ভোট নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহ নেই।