এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ‘ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ কারও কাছ থেকে ১০ লাখ, কারও কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে জামায়াত-বিএনপির কর্মীকে চাকরি দিয়েছেন। স্ত্রীর গ্রিন সিগন্যালেই স্কুল, কলেজসহ স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে বিতর্কিতরা। অথচ ছাত্রলীগের শিক্ষিত ছেলেরা ডেইলি লেবার দিয়ে ভাত খাচ্ছে। শুনতে খারাপ লাগলেও ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ায় বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে। দল করতে এসে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেক ছাত্রলীগ কর্মী। তাদের চোখের পানি আমাদের ব্যথিত করে। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না।’
এক শ্বাসে কথাগুলো প্রতিবেদককে বলেন, ঈশ্বরদীর ছলিমপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অবসরপ্রাপ্ত নায়েক আবদুল কাদের। এলাকায় তিনি স্পষ্টভাষী হিসেবে পরিচিত। পৈতৃক জমি বিক্রি করে নির্যাতিত ও নিরীহ কর্মীদের সহযোগিতা করে এলাকায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই নেতা। তার দেয়া তথ্য তালাশ করতে গিয়ে কামরুন্নাহার শরীফের চাকরি বাণিজ্যের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শামসুর রহমান শরীফ এলাকার সংসদ সদস্য ও ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকলেও সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেন তার স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফ। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের বরাদ্দ বণ্টনের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মন্ত্রীপত্নীর আধিপত্য নির্বাচনী এলাকার সর্বত্র। কার কোথায় চাকরি, পোস্টিং ও বরাদ্দ হবে সবই নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফকে টাকা দিয়ে চাকরি পাননি ৬ ছাত্রলীগ কর্মী। তারা একসঙ্গে ৩০ লাখ টাকা দিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। চাকরি দেয়ার কথা বলে বিপুল অঙ্কের এই টাকা হাতিয়ে নেন কামরুন্নাহার। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে এই টাকা ধার করে মহাসংকটে পড়েছেন ছাত্রলীগের ৬ কর্মী। কেউ কেউ টিউশনি করে প্রতি মাসে যে টাকা পান তা দিয়ে সুদ পরিশোধ করে কোনোরকম দিন পার করছেন।
গত তিন বছর ধরেই তারা সুদের ঘানি টেনে আসছেন। চাকরিতো দূরের কথা এখন মন্ত্রীর বাড়ির বারান্দায়ও যেতে পারছেন না তারা। উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক একজন সভাপতিকে সঙ্গে নিয়ে এই টাকা দেয়া হয়। চাকরি না হওয়ায় টাকা চাইতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হন ওই ছাত্রলীগ নেতা। ভয়ে তিনিও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস করেননি।
ভূমিমন্ত্রীর স্ত্রীকে ৩০ লাখ টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করে ঈশ্বরদী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক ওই সভাপতি বলেন, ‘ছাত্রলীগের যে ৬ কর্মী টাকা দিয়েছে তারা খুবই গরিব ও নিরীহ প্রকৃতির। ভয়ে তারা সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে সাহস করবে না। তবে ঘটনা সত্য।’
চাকরি না হওয়ায় টাকা ফেরত চেয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘টাকা চাইতে গিয়েই তো রোষানলে পড়েছি। আমার বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছে। মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। তবে আমি ভীত নই। টাকা যে তিনি নিয়েছেন তার ডকুমেন্ট আছে। কামরুন্নাহার অস্বীকার করলে দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানানো হবে।’
যারা প্রতারিত : ঈশ্বরদী ছাত্রলীগের যে ৬ কর্মী ভূমিমন্ত্রী কামরুন্নাহার শরীফকে টাকা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে তাদের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এরা হলেন ঈশ্বরদী পৌর এলাকার আমিনপাড়ার ইসমাইল ড্রাইভারের ছেলে মিলন হোসেন, উমিরপুরের রজব আলীর ছেলে রিপন, মণ্ডল গলির পান্না সরদারের ছেলে রোমেল, আমিনপাড়ার আবুল কালামের মেয়ে সিমু খাতুন, শৈলপাড়ার হায়দার আলীর ছেলে আবদুল গালিম ও বড়ইচড়ার মাসুম।
ভুক্তভোগীরা ছাত্রলীগ কর্মী। টাকা দিয়ে প্রতারিত কয়েকজনের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথাও হয়। কিন্তু হামলা-মামলার ভয়ে তারা নাম প্রকাশ করতে সাহস করেননি। এর মধ্যে এক ছাত্রলীগ কর্মীর অভিভাবক বলেন, ‘ঈশ্বরদীতে অবস্থিত বাংলাদেশ সুগার ক্রপ ইন্সটিটিউটে (বিএসআরআই) চাকরির জন্য অনেক কষ্টে ৮ লাখ টাকা জোগাড় করে কামরুন্নাহার শরীফকে দিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরি দেয়ার কথা ছিল। সেখানে তিন বছর হয়ে গেছে। চাকরি তো পাওয়াই যায়নি, টাকাও ফেরত দেয়া হয়নি।’
নিজের হাতে টাকা দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘হ্যাঁ, নিজের হাতেই দিয়েছি। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতির নাম উল্লেখ করে বলেন, তিনিও সঙ্গে ছিলেন। এই অভিভাবক বলেন, ‘চড়া সুদে এনে সম্পূর্ণ টাকা দেয়া হয়েছে। এখন সুদ পরিশোধ করতেই শেষ হয়ে যাচ্ছি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, না পারছি কারও কাছে এ কথা বলতে, না পারছি সইতে।’
তিনি বলেন, ‘কামরুন্নাহার যদি জানতে পারে আমি সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছি তাহলে আমাকেও শেষ করে দেবে। এভাবে আমি ছেলের চাকরির জন্য টাকা দিয়ে শেষ হয়ে যাব তা কখনো কল্পনাতেও আসেনি। ডিপ্লোমা উত্তীর্ণ তার একমাত্র ছেলে এ সময় বাবার পাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এখন কি করছে ছেলে জানতে চাইলে বলেন, ডেইলি লেবারের কাজ করছে।
একই প্রতারণার শিকার আরেক ছাত্রলীগ কর্মী বলেন, ‘মাস্টার্স সম্পন্ন করে এখন টিউশনি করছি। মাসে যা পাই তার পুরোটাই দিতে হচ্ছে সুদ। কি করে সংসার চলে বুঝে নেন।’ কত টাকা দিয়েছিলেন জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম।’
কঠিন রোগে আক্রান্ত ছাত্রলীগের এই কর্মী বলেন, ‘আমার প্রতি মাসে ওষুধ কিনতে যে টাকা লাগে তাও জোগাড় করতে পারছি না। এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।’ টাকা ফেরত চেয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘ফেরত চাইলে কি হবে, দেই-দিচ্ছি বলে শুধু সময়ক্ষেপণ করেন। আবার বেশি কথা বলতে পারি না সন্ত্রাসী লেলিয়ে দেয়ার ভয়ে। একসঙ্গে তারা ৬ জন মোট ৩০ লাখ টাকা দেয়ার কথা স্বীকার করেন।
অভিযোগের বিষয়ে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। শনিবার বিকাল সাড়ে তিনটার পর কয়েকবার তার মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ৩টা ৩৪ মিনিটে প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠান। ক্ষুদে বার্তায় বলা হয়, ‘মাননীয় ভূমিমন্ত্রী আপনার নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলা প্রয়োজন।’ মুঠোফোন রিসিভ করতে অনুরোধ জানানো হয়। এরপরও মুঠোফোন রিসিভ হয়নি।