এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২৩টির খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর মধ্যে সরকারি খাতের ৮টি ব্যাংকের মধ্যে একটি ছাড়া বাকি ৭টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ এই সীমা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে। এছাড়া বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের মধ্যে ১৫টি এবং বিদেশি ৯টি ব্যাংকের মধ্যে ১টির খেলাপি ঋণ হাজার কোটি টাকার ওপরে রয়েছে। এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকা, যা ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৮৩.৫ শতাংশ।
বাকি ৩৪টি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা, যা মোট খেলাপি ঋণের সাড়ে ১৬ শতাংশ। মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৫৮৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ যুক্ত করা হলে খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ৪৪ হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের বড় অভাব রয়েছে। এ কারণে জাল-জালিয়াতির প্রবণতা বেড়ে গেছে। যারা জালিয়াতি করছে, তাদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালাগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে না। এর সার্বিক প্রভাব পড়েছে ঋণ ব্যবস্থাপনায়। জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া টাকা আদায় না হওয়ায় সেগুলো এখন খেলাপি হচ্ছে।
অপর একজন অর্থনীতিবিদ জানান, ব্যাংকগুলোয় জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেয়া হয়েছে, সেগুলোই এখন খেলাপি হয়েছে। এসব জালিয়াতির সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া উচিত। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে তারা যেসব সম্পদ অর্জন করেছেন, সেগুলো বাজেয়াপ্ত করাসহ দ্রুত তাদের জেলে পাঠানো গেলে নতুন জালিয়াতি করতে অন্য কর্মকর্তারা ভয় পাবেন। জনগণের স্বার্থে চিহ্নিত প্রভাবশালী খেলাপিদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেয়া জরুরি বলে মত দেন তিনি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র দাবি করে, যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বেশি আছে, তাদের ব্যাপারে বিশেষ মনিটরিং করা হচ্ছে। আদায় বাড়িয়ে খেলাপি ঋণের হার কমাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জুন পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেসব তথ্য এসেছে তাতে দেখা যায়, আদায়ের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেখে ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং করে না, দেখে খেলাপি ঋণের হার। ঋণ বিতরণ অনেক বেশি হলে হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ২ বা ৩ শতাংশও হতে পারে। এ কারণে শতকরা হারই বিবেচনায় নেয়া হয়।
সূত্র জানায়, জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট লেদারে ৫০০ কোটি টাকা, অ্যানন টেক্সে ৫৫০ কোটি টাকাসহ আরও কয়েকটি গ্রুপে বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এসব খাতে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। এমনকি ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কিনেছে ব্যাংকটি। যেগুলো নিয়মিত করার পর এখন আবার খেলাপি হয়ে গেছে। বেসিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ার একমাত্র কারণ জালিয়াতি।
তাদের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে বেরিয়ে গেছে। যে কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অপর একটি ব্যাংকে হলমার্ক জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা, চট্টগ্রামে জালিয়াতি হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা।
রমনা শাখায় জালিয়াতি হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, দিলকুশা বৈদেশিক বাণিজ্য ও স্থানীয় কার্যালয় শাখায়ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকারি খাতের ৭ ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর এই হার ৫ থেকে ১০ শতাংশ এবং বিদেশি একটি ব্যাংকের এই হার ৯৫ শতাংশ।
সরকারি ৭ ব্যাংকের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৫৯ দশমিক ২২ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ৯ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা, মোট ঋণের ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৬০১ কোটি টাকা, মোট ঋণের ২২ শতাংশ। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) ৪ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা, মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা, মোট ঋণের ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। সরকরি আরও দুটি ব্যাংকের মধ্যে একটি ব্যাংকের ১৪ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অপর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২০ শতাংশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ১৭২ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ব্যাংক এশিয়ার ১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১ হাজার ৩০ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ২০ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংকের ১ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। আইএফআইসি ব্যাংকের ১ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা, মোট ঋণের সাড়ে ৮ শতাংশ। ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৬ দশমকি ১৭ শতাংশ।
প্রাইম ব্যাংকের ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পূবালী ব্যাংকের ২ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা, মোট ঋণের ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। সাউথইস্ট ব্যাংকের ১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা বা ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সিটি ব্যাংকের ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
ইসলামী শরিয়াভিত্তিতে পরিচালিত একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের সাড়ে ৫ শতাংশ। আরও একটি দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৯৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
এছাড়াও আরও তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হাজার কোটি টাকার নিচে হলেও তাদের মোট ঋণের ২৩ থেকে ৮০ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে- সরকারি খাতের বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেডের (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণ ৮০৪ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। বেসরকারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের (বিসিবি) ৪৫৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ২৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। বিদেশি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৭০৩ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৮০ দশমিক ১৭ শতাংশ।