এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রথম থেকেই জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্ত ছিলেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়াও। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এমন কোনো মাস নেই জিয়াউর রহমান সস্ত্রীক অন্তত একবার আমাদের বাড়িতে আসতেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে এই ঘন ঘন আসার মধ্যেও ষড়যন্ত্র ছিল। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণ এবং জিয়াকে সেনাপ্রধান বানানো ও বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তে স্যার টমাস উইলিয়ামকে আসতে না দেয়া জিয়ার সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতাবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, খুনিদের রাজত্ব এ দেশে আর কায়েম হতে দেয়া হবে না। একই সঙ্গে সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে একটি মহল দেশ অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল বলেও সরকারপ্রধান অভিযোগ করেন।
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিহত সব শহীদের স্মরণে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান মেজর ছিল। প্রমোশন দিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তো তাকে মেজর জেনারেল করেছিলেন। জিয়া যে রাষ্ট্রপতি হল, সূত্রটা যদি খোঁজা হয়, দেখা যাবে জিয়া ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। আমি তো বলব, একটা এজেন্ট হিসেবেই কাজ করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতায় এলো খন্দকার মোশতাক। তিনি সেনাপ্রধান বানালেন জিয়াউর রহমানকে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর খুনে লাভবান মোশতাক জিয়াকেও পুরস্কৃত করলেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য আমি ১৯৮০ সালে লন্ডনে গিয়ে স্যার ম্যাকব্রাইট এবং স্যার টমাস উইলিয়ামকে দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করি। তারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময়ও বাংলাদেশে এসেছিলেন তদন্ত করতে। অথচ জিয়াউর রহমার তাদেরকে বাংলাদেশে আসার ভিসা দেননি। এ হত্যার তদন্তে জিয়াউর রহমান বাধা দিয়েছিলেন কেন? যদি তিনি ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িত নাই থাকেন তাহলে বাধা দেবেন কেন? জিয়া সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন। আর জাতির পিতার আত্মস্বীকৃত খুনি, তাকে সংসদে বসিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী (খালেদা জিয়া)। তার অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? জিয়া একা নন, তার স্ত্রীও এ হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- এতে কোনো সন্দেহ নেই। খুনিরা খুনিই হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ বারবার আমার ওপর আঘাত হেনেছে। কাজেই এদের হাতে ক্ষমতা গেলে দেশের মানুষ কী উন্নয়ন পাবে, কী ন্যায়বিচার পাবে- সে প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী।
সমালোচনা ও নানা অভিযোগ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয় বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এর মধ্যেই এটা নেই, ওটা নেই, এটা হচ্ছে না বলা হল। আর এসবেরই ফল ১৫ আগস্ট।
স্মরণসভায় আরও বক্তব্য দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, আইন সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, কার্যনির্বাহী সদস্য সিমিন হোসেন রিমি ও আনোয়ার হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সভা পরিচালনা করেন দলের প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন।
জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক দাবির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়া সংবিধান লঙ্ঘন করে মার্শাল ল’ দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার সময় হত্যা, গুম, অস্ত্রের ঝনঝনানি লেগেই থাকত। তিনি হাজার হাজার সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করেছেন। তিনি কী করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক হন।
এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের ‘দেশ ও জাতির শত্রু’ আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের যখন উন্নতি হচ্ছে তখন এ শ্রেণীর মানুষের মন খুব খারাপ। তিনি এ সময় সাম্প্রতিক স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যারা উসকানি দেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। স্কুল শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের উসকানিদাতাদের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা শিশুদের আন্দোলনে উসকানি দিয়েছিল, যারা শিশুদের নিয়ে খেলতে চেয়েছিল, শিশুদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়; তারা আর যাই হোক বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারে ঠেলে দিতে চায়, আলোর পথের যাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। আওয়ামী লীগ সভাপতি এ সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের সমালোচনা করে বলেন, কিছু কিছু পত্রিকায় দেখবেন, যেন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা কমানোই যেন তাদের একমাত্র কর্তব্য। কারণ, যখন বাংলাদেশে অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন তাদের খুব কদর বাড়ে। এরা সুযোগসন্ধানী। এদের কারণে বাংলাদেশের মানুষকে বারবার বিপদে পড়তে হয়েছে, অধিকার হারা হতে হয়েছে। এরাই ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। এরা এখনও তাদের পূর্ব প্রভুদের ভুলতে পারে না। পাকিস্তানিদের পা চেটে খাবে এটাই তাদের চরিত্র। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের যখন উন্নতি হয়েছে, তখন এ শ্রেণীর মানুষের মন খুব খারাপ। বাংলাদেশের মানুষের ভালো তাদের ভালো লাগছে না। কাজেই এরা জাতির শত্রু, এরা দেশের শত্রু। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী ও জাতির পিতার খুনিরা চায় না বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াক। তারা যে এটা চায় না, তার দৃষ্টান্ত এখনও আপনারা দেখতে পান। বাস দুর্ঘটনায় দু’জন শিক্ষার্থী মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় নামোল্লেখ না করে দৃকের পরিচালক আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের বিষয়ে বলেন, অনেক নামি-দামি, জ্ঞানী, অনেক বড় আঁতেল, অনেক ইন্টেলেকচুয়াল কিন্তু তাদের রক্তের সূত্রটা কোথায়। বাংলাদেশবিরোধী খান এ সবুরের বোনের মেয়ে জামাই। ওই ধরনের যারা পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী, তাদেরই বংশধর থেকে শুরু করে অনেকেই এর মধ্যে জড়িত। আবার তাদের ধরলে দেখি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খুব হৈচৈ। সরকারপ্রধান বলেন, শিশুদের উসকানি দিয়ে যারা দেশকে অস্বাভাবিক করতে চান, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। কেউ যদি মনে করেন খুব নামি-দামি লেখক, সাংবাদিক বলেই তাদের অপরাধ আর অপরাধ না। তাদের অপরাধ সব মুছে যাবে। আমাদের সরকারের সময় তথ্য প্রকাশের স্বাধীনতা আছে বলেই কেউ কেউ এদের সমর্থনে লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু যে অন্যায় তারা করতে যাচ্ছিল, দেশটাকে কোন দিকে নিতে যাচ্ছিল, সেটা কী তারা উপলব্ধি করেন? তারা অনেক জ্ঞানী, জনপ্রিয় হতে পারেন কিন্তু তাদের মধ্যে কি একটুও দায়িত্ববোধ থাকবে না। যারা শিশুদের ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চায় তাদের কী বাহবা দিতে হবে? আর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সেটা কি অন্যায় হয়ে যাবে? দেশকে রক্ষা করা, দেশের মানুষকে রক্ষা করা- এটাই তো আমার কর্তব্য।
শিশুদের আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বুড়োরা হঠাৎ স্কুল ড্রেস পরে ছোট ছোট হতে চাইল। কেন? উদ্দেশ্যটা কী? এরা কোন স্কুলের ছাত্র। এদের গ্রেফতার করলে কাদের দুঃখ? কাদের হাহাকার? আন্তর্জাতিক সাংবাদিক এবং আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবী তারা কী চোখ খুলে দেখবেন না? উসকানিদাতাকে গ্রেফতার করা হলে আর্টিকেল লিখতে পারেন। আর যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল, তারা কী এর বিরুদ্ধে কলম ধরবেন না? কলমের কালি ফুরিয়ে গেল, তাই লিখতে পারছেন না। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল বলে লিখতে পারছেন না। প্রশ্ন এখানে, যে যত বড়ই হোক, তার কী বিচার হবে না বাংলাদেশের মাটিতে? তাহলে আমাদের যুক্তি এটাই খুঁজতে হয়। যারা ১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে জড়িত, এখনও যারা এ চক্রান্ত করে যাচ্ছে, বংশপরম্পরায় যারা করছে- বাংলাদেশের মানুষকে বলব এদের সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। কারণ, এরা বাংলাদেশের উন্নয়ন, বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ- ভালো দেখতে চায় না।
নিজের বাবা-মা, ভাই হত্যার বিচারের জন্য ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আক্ষেপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন দেশে একটা হত্যাকাণ্ড হলে মানুষ বিচার চায়। আমি যেহেতু সরকার প্রধান আমার কাছে বিচার চাইতেই পারে। তারা কী একবারও ভেবে দেখেছে আমি একদিনে বাবা হারিয়েছি, মা হারিয়েছি, ভাই হারিয়েছি। খুনিরা জাতির পিতাকে হত্যা করল, শিশু হত্যা করল। কই আমরা তো বিচার চাইতে পারিনি। ১৯৭৫-এর পর কতজনই তো ক্ষমতায় এসেছে, কেউ আমার বাবার হত্যার বিচার করেনি। আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর এ বিচার করতে সক্ষম হয়েছি। আমি ক্ষমতায় না এলে হয়তো বিচারই হতো না। খুনিদের রাজত্ব এ দেশে আর আসবে না, আসতে দেয়া হবে না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে- আজকের দিনে এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। আজকে আমরা ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়েছি। দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ ইনশাআল্লাহ আমরা করব।
তোফায়েল আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, বঙ্গবন্ধু যেখানেই গেছেন সবাই তাকে নিপীড়িত-শোষিত মানুষের শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বিদেশিরা যে সাহস করে নাই সেখানে আমাদেরই দেশের কিছু কুলাঙ্গার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে রক্ত দিয়ে জাতিকে রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। একই ধরনের ষড়যন্ত্র এখনও চলছে অভিযোগ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ এক থাকলে কেউ কিছু করতে পারবে না।
মোহাম্মদ নাসিম বলেন, পৃথিবীর সব দেশে মহানায়কের মূল্যায়ন হয়েছে কিন্তু এদেশে মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়নের অপচেষ্টা করা হয়েছে বারবার। তার জন্মদিনে একটি দলের নেত্রী ভুয়া জন্মদিন পালন করেন বলে উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এদের সম্পর্কে সচেতন থাকার আহ্বান জানান।