এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : চলমান এগারোটি ইস্যুকে অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের রূপরেখার খসড়া চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। এতে স্থান পাওয়া ইস্যুগুলোর মধ্যে অন্যতম হল- খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং কোটা ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি। এ ব্যাপারে মতৈক্যে পোঁছাতে ঐক্য প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন বিএনপি নীতিনির্ধারকরা। সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই রূপরেখায় এসব ইস্যু অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রয়োজনে অন্য দলগুলোর কোনো প্রস্তাব থাকলেও তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেয়া হবে। দলটির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
তারা আরও জানান, শুধু খালেদা জিয়ার মুক্তির ইস্যুটি অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে শুরুতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট দুটি দল আপত্তি জানায়। পরে খালেদা জিয়াসহ সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তির বিষয়টি বৃহত্তর ঐক্যের রূপরেখার খসড়ায় উল্লেখ করা হলে, সেটি মেনে নেয় ওই দুটি দল।
বৃহত্তর ঐক্যের রূপরেখার বাকি ইস্যুগুলো হল- বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া, নির্বাচনের সময়ে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি বাতিল, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বিরোধী নেতাকর্মীদের নামে নতুন মামলা ও গ্রেফতার অভিযান বন্ধ।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রূপরেখার খসড়া বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছাতে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের সঙ্গে স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, বিকল্পধারার একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৈঠক করেছেন, যা এখনও অব্যাহত আছে। এছাড়া বাম জোটের সঙ্গে আলোচনা করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে সরকারের বাইরে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়াসহ নানা ইস্যুতে ওই সব দল প্রোগ্রাম করবে, আমাদের সঙ্গে থাকবে এ ধরনের কথাবার্তা হয়েছে।
স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা বলেন, খালেদা জিয়া শুধু বিএনপির নেত্রী নন, তিনি দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। গণতন্ত্রের জন্য আজ তিনি কারাগারে রয়েছেন বলে মনে করছে দেশের সব রাজনৈতিক দল। তাই খালেদা জিয়াসহ কারাবন্দি সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মুক্তি ইস্যুকে প্রধান ইস্যু করা বিষয়ে সবার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যার আবদুল আউয়াল মিন্টুর গুলশানের বাসায় যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত একটি দলের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য, দু’জন ভাইস চেয়ারম্যানও উপস্থিত ছিলেন। সেখানে বিএনপির ইস্যুভিত্তিক রূপরেখার ব্যাপারে একমত পোষণ করেন ওই নেতা। তিনি বিএনপি নেতাদের এও বলেন, খালেদা জিয়া একক কোনো প্রতিষ্ঠান নন। তিনি সবার নেত্রী। তাই এ ইস্যুকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের সব রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জাতীয় নির্বাচনের আগে মুক্তি ইস্যুর সঙ্গে ওই নেতা একমত পোষণ করেন।
সূত্র জানায়, গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও এ বিষয়ে একাধিকবার বৈঠক করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বিকল্পধারার একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে তার বারিধারার বাসায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও একাধিবার বৈঠক হয়। ঈদের আগে বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে বি চৌধুরীর আবারও বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও কথা বলেছেন বিএনপির এক ভাইস চেয়ারম্যান।
বিএনপির এক নীতিনির্ধারক বলেন, বিকল্পধারার প্রত্যাশার মাত্রা অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের চেয়ে তাদের চাওয়ার মাত্রা অতিরঞ্জিত বলে মনে হয়েছে তাদের। এ কারণে বি চৌধুরীর পাশাপাশি তার ছেলে মাহী বি চৌধুরীর সঙ্গেও তাদের বৈঠক করতে হয়েছে। এসব বৈঠকে তাদের কাছে মনে হয়েছে- ক্ষমতায় যেতে পারলে বিএনপির পক্ষ থেকে বি চৌধুরীকে সরকার প্রধান অথবা আবারও রাষ্ট্রপতি করার নিশ্চয়তার একটি শর্ত রয়েছে। তিনি এও বলেন, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বিএনপি যদি সরকার গঠন করে তাহলেও প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি করার ক্ষেত্রে বি চৌধুরীর চেয়ে এগিয়ে ড. কামাল হোসেন। কারণ ড. কামাল সব দিক থেকে সিনিয়র। কিন্তু সেখানে বি চৌধুরী এ পদের বিষয়ে আগ্রহী হওয়ার কোনো কারণ দেখছেন না তিনি।
তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, আমি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী চাই এসব যারা বলছেন তারা ঐক্যে বাধা সৃষ্টি করতে এগুলো বলছেন। এ বয়সে আমি কোনো কিছু চাওয়ার চিন্তাও করি না। আমি গণতান্ত্রিক দেশ চাই। সাংবিধানিক দেশ চাই। তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে লেগেই আছি। জাতীয় ঐক্যর বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জানতে বি চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার প্রেস সচিব জাহাঙ্গীর আলম জানান, স্যার জাতীয় ঐক্যের ব্যাপারে এখনই কোনো কথা বলতে চান না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, স্বাভাবিকভাবে একটি প্রশ্ন আসতেই পারে যে, বিএনপি যদি সরকার গঠন করে তাহলে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন। তাদের দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া দণ্ডিত। তাহলে তারা কি দল থেকে প্রধানমন্ত্রী করবেন না অন্য দল থেকে হবে। তবে ঐক্য সংক্রান্ত কোনো বৈঠকে এ বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বৃহত্তর ঐক্যের বিষয় এখনও চূড়ান্ত হয়নি। তবে এ মাসেই অনেকখানি এগোবো।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এ ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরেই বিএনপি, গণফোরাম, বিকল্পধারা, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নিয়ে সরকারবিরোধী বৃহত্তর জোট গঠন হতে পারে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, একটি সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হতে হবে। এখন সরকার যদি পুলিশ আর আমলা দিয়ে নির্বাচন করে তাহলে তো আর সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হলে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য নিশ্চিত করতে হবে।