এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর অঙ্গীকার শুধুই ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হয়েছে। বারবার সময় বেঁধে দেয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ ব্যাংক তা অগ্রাহ্য করেছে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর নির্দেশ, ব্যাংক পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) প্রতিশ্রুতির পরও এ হার ৯ শতাংশের মধ্যে আসেনি।
জুলাই পর্যন্ত ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৪টি ব্যাংকের শিল্পঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমেছে। বাকি ৪৩টি ব্যাংকে সুদহার ডাবল ডিজিটেই রয়ে গেছে। এ মাসের শুরুর দিকে দুটি বেসরকারি ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়েছে। তবে তারা ঋণের সুদহার কমায়নি।
এদিকে শিল্প ঋণের সুদহার কিছু ব্যাংকে কমলেও এর বিপরীতে বিভিন্ন চার্জ, ফি বা কমিশনের খড়গ তো আছেই। এসব মিলে সুদহার ডাবল ডিজিটেই থাকছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সিঙ্গেল ডিজিটের ঘোষণা অবশ্য ফাঁকা বুলিই ছিল। হঠাৎ করে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনা কঠিন। তবে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনতে হবে। জোর করে নামানো যাবে না। যারা ভালো গ্রাহক, তাদের অবশ্যই সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ দেয়া উচিত। তবে এর সঙ্গে অন্য চার্জের বোঝা যেন না বাড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির পক্ষ থেকে ঘোষণা ছিল ১ জুলাই থেকে সব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করবে। সরকারি ব্যাংকগুলোও এর বেশি সুদ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা আলাদাভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে জানিয়ে আসেন অধিকাংশ ব্যাংক জুলাই থেকে উৎপাদনশীল খাতে এক অংকের সুদে ঋণ বিতরণ শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়া ব্যাংকগুলোর জুলাইয়ের প্রতিবেদনে এ প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নেই। জুলাইয়ে উৎপাদনশীল খাতে দুই অংকে সুদ নিয়েছে ৪৩টি ব্যাংক।
ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। এর আলোকে অর্থমন্ত্রীও একাধিকবার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে এ হার কমানোর নির্দেশ দেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে আসছে না। এ বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘সুদ হারের বিষয়টি প্রতিনিয়ত তদারক করা হচ্ছে। প্রতিশ্রুতির চেয়ে কোনো ব্যাংকের বিরুদ্ধে বেশি সুদ নেয়ার তথ্য পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে সুদহার নির্ধারণ করে। তবে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কোন ব্যাংক কোন খাতে কী পরিমাণ সুদ নিচ্ছে, তার একটি প্রতিবেদন প্রতি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। জুলাইয়ের এমনই এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উৎপাদনশীল খাতের ঋণ হিসেবে বিবেচিত শিল্পের মেয়াদি ঋণে ২ অঙ্কের সুদ নিয়েছে অধিকাংশ ব্যাংক। আর শিল্পের মেয়াদি ঋণের তুলনায় চলতি মূলধন, ট্রেড ফাইন্যান্স, গৃহঋণে আরও বেশি সুদ নেয়া হয়েছে। ফলে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা সুবিধা নিয়েও সুদহার কমানোর যে ঘোষণা ব্যাংকগুলো দিয়েছে তা শুধুই ফাঁকা আওয়াজে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক জুলাইয়ে শিল্পের মেয়াদি ঋণে সুদ নিয়েছে ১২ দশমিক ২৫ থেকে ১২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। শিল্প খাতের চলতি মূলধন ঋণ বিতরণ করেছে ১৩ শতাংশ সুদে। আর বাণিজ্যি (ট্রেড ফাইন্যান্স) ঋণে ১৩ শতাংশ সুদ নিয়েছে।
শুধু বেসিক ব্যাংক নয়, বিডিবিএল শিল্প ঋণ বিতরণ করেছে ১২ শতাংশ সুদে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর চিত্র এর চেয়ে আরও খারাপ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, জুলাইয়ে ব্যাংক এশিয়া বড় ও মাঝারি শিল্পের মেয়াদি এবং চলতি মূলধন ঋণে সুদ নিয়েছে সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ। এছাড়া বাণিজ্য (ট্রেড ফাইন্যান্স) ঋণে সুদ নিয়েছে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ। একই ভাবে এবি ব্যাংক বাণিজ্য ঋণে সুদ নিয়েছে ৯ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। ব্র্যাক ব্যাংক শিল্পে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ডাচ্-বাংলা ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ফারমার্স ব্যাংক ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ১৫ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক সাড়ে ১৩ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, মার্কেন্টাইল ব্যাংক বাণিজ্যে সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, মেঘনা ব্যাংক ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, মধুমতি ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল বাণিজ্যে ৯ থেকে ১৪ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, সাউথ বাংলা ব্যাংক বাণিজ্যে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড বাণিজ্যে ৯ থেকে ১২ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ এবং উত্তরা ব্যাংক বাণিজ্যে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ নিয়েছে। বিদেশি ৯টি ব্যাংকও শিল্প ও বাণিজ্যের কোনো ক্ষেত্রে ২ অঙ্কের সুদ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুদহার নিুমুখী ধারায় ছিল। তবে গত বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে বিনিয়োগ বাড়তে থাকায় নগদ টাকার ওপর চাপ তৈরি হয়। আবার ফারমার্স ব্যাংক আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার খবরে ব্যাংক আমানতে এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়। এ রকম সময়ে জানুয়ারিতে হঠাৎ করে এডিআর কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সব মিলিয়ে সুদহার হু হু করে বেড়ে দুই অংকে উঠে যায়। সুদহার কমাতে ব্যাংকগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনার আলোকে ২০ জুন বিএবির এক বৈঠকে ১ জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিটে সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয়া হয়। এটি ঠিকমতো কার্যকর না হওয়ায় ২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে আবার বৈঠক করেন। সেখানে জানানো হয়, অধিকাংশ ব্যাংক উৎপাদনশীল খাতে সুদহার এক অংকে নামিয়েছে। আর ৯ আগস্ট থেকে ভোক্তা ঋণ ও ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে এক অংকে নামানো হবে। এ রকম বক্তব্য দেয়া হলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, তারল্যের ওপর বাড়তি চাপের কারণে মাঝে ব্যাংকগুলোকে উচ্চসুদে আমানত নিতে হয়েছে। এতে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তবে সুদহার এখন নতুন করে বাড়ছে না; বরং নিুমুখী ধারায় রয়েছে।