এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার পরিকল্পনা আছে ইসির। ইভিএম ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ফের আলোচনার আভাস দিয়েছেন ইসির সচিব। ডিসেম্বরের শেষদিকে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনের আগেই এসব বিষয় চূড়ান্ত হবে। এর আগে আইনগত ভিত্তি তৈরির জন্য ইভিএম ব্যবহারের বিধান যুক্ত করে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন হচ্ছে। আগামীকাল এ লক্ষ্যে বৈঠকে বসছে নির্বাচন কমিশন। তবে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
আসন্ন নির্বাচনে ক’টি আসন বা কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হবে সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে সব পক্ষ সম্মত হলে এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ইঙ্গিত দেন ইসি সচিব। সেক্ষেত্রে হিসাব অনুযায়ী একশ’ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভোট গ্রহণ হতে পারে। মঙ্গলবার ইসি সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ এসব কথা বলেন।
ইভিএম ব্যবহার প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ইভিএম ব্যবহারে সব দলের ঐকমত্য হতে হবে। মানুষের মনে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটা না করে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এজন্য আস্তে আস্তে ইভিএম ব্যবহার শুরু করতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক দল ও মানুষের মধ্যে অনীহা আছে। এ কারণে আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা ঠিক হবে না। তড়িঘড়ি করে ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হলে মানুষের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হবে, আস্থার অভাব থাকবে।
ইসি সচিব বলেন, দেড় লাখ ইভিএম কেনার একটি প্রকল্প এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে ইসি। এছাড়া আগামীকাল অনুষ্ঠেয় বৈঠকে ইভিএম ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি তৈরি হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে বলেও জানান ইসি সচিব।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, আমি জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে, তবে এখনই ব্যবহারের পক্ষে নই। মানুষকে এ বিষয়ে আস্থায় আনতে হবে, জনমত সৃষ্টি করতে হবে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে হবে। তিনি বলেন, ইভিএমে ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে শুনেছি। তাহলে নির্বাচনে গোপনীয়তা নষ্ট হবে।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির কর্মকর্তারা জানান, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে ইসি সচিবালয়। এরই অংশ হিসেবে আরপিও সংশোধন এবং দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। এসব ইভিএম দিয়ে প্রায় অর্ধেক আসনে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, সব পক্ষ একমত হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা নির্বাচন কমিশনের আছে। এখন থেকে এর প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। ভোটারদের সম্পৃক্ত করে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মেলা অনুষ্ঠিত হবে। সেপ্টেম্বর মাসেই বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এ মেলা করার পরিকল্পনা আছে। এছাড়া ইসির দশটি অঞ্চলেও মেলা আয়োজন করা হবে। কেন্দ্রীয় মেলার আয়োজনে আমরা প্রস্তুতি সভা করেছি।
এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে আইনগত ভিত্তি লাগবে। আরপিওতে ইভিএম ব্যবহার করার ধারাগুলো সংযোজন করতে হবে। ২৬ আগস্ট কমিশন সভা হয়েছে। সেখানে ওইভাবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আরপিওতে ইভিএম ধারাগুলো সংযোজন করা হবে কিনা সে ব্যাপারে আগামী ৩০ আগস্ট আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। ওখানে সিদ্ধান্ত হতে পারে। যদি আরপিওতে ধারাগুলো সংযোজন হয় তবে ইভিএম ব্যবহারে আমাদের একটি প্রস্তুতি থাকবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ইসির সিদ্ধান্ত রয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে ইভিএম করার পরিকল্পনা আছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে বেশ সফলতা পেয়েছি। এটা মাথায় রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই ৫০০টি উপজেলায় নির্বাচন হবে। ওই উপজেলা নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে।
আরপিও সংশোধন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কমিশন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে। এরপর মন্ত্রিসভায় ও পরে সংসদ অধিবেশনে উঠবে। পার্লামেন্টে অনুমোদনের পর সেটা আইন হিসেবে প্রকাশ করা হবে। তিনি জানান, সংসদ নির্বাচনে একটা কেন্দ্রেও যদি আমরা ইভিএম ব্যবহার করি তাহলে আইনগত ভিত্তি লাগবে।
সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে, অন্য কিছু নিয়ে নয়। রাজনৈতিক দল আমাদের প্রধান স্টেকহোল্ডার। তিনি বলেন, উপজেলা পরিষদে ব্যাপকভাবে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে পরিকল্পনা আছে। উপজেলা নির্বাচন ধাপে ধাপে করব। মানুষকে আস্তে আস্তে ইভিএম ব্যবহারে অভ্যস্ত করতে হবে।
রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই আরপিওতে ইভিএম অন্তর্ভুক্তের বিষয়ে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, আরপিওতে ইভিএম ব্যবহার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হলে আইনগত ভিত্তি আসবে। তবে সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করব কী করব না তা পরের ব্যাপার। যেমন লোকাল গভর্নমেন্ট আইনে ইভিএম ব্যবহার করার ভিত্তি আছে। আমরা কিন্তু কোনো কোনো পৌরসভায় ইভিএম ব্যবহার করি, আবার কোনো কোনো পৌরসভায় ইভিএম ব্যবহার করি না। এটা প্রভিশন থাকলে যে ব্যবহার করব এমন তো নয়। প্রভিশন থাকলে ব্যবহার করতেও পারি, নাও করতে পারি।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ৩৮০টি ইভিএম কেনা হয়েছে। প্রতিটি বুথে একটি ইভিএম লাগে। একটি কেন্দ্রে ৮-১০টি পর্যন্ত বুথ লাগে। সে হিসাবে এক কেন্দ্রে ১০-১২টি ইভিএম লাগে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প তৈরি করেছি। প্ল্যানিং কমিশনে পাঠিয়েছি। প্ল্যানিং কমিশন যদি গ্রহণ করে তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হতে পারে জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, এখনও তারিখ নির্ধারণ হয়নি। তবে ৩০ অক্টোবর থেকে নির্বাচনের কাউন্টডাউন শুরু হবে। ধরে নিতে হবে কাউন্টডাউনের তারিখের পর থেকে যে কোনো সময় তফসিল ঘোষণা হতে পারে। গতবার ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছিল। এবার আমাদের প্ল্যান হল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে হতে পারে। কারণ ১ তারিখ থেকে একাডেমিক সেশন শুরু হয়। ১ তারিখ বই বিতরণ উৎসব আছে। ডিসেম্বরের মধ্যে সব পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতির ৮০ ভাগ হয়েছে। তিনশ’ আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনশ’ আসনের ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজ কমপ্লিট। এরপর ভোট কেন্দ্রে। ৪১ হাজার বা ৪২ হাজার ভোট কেন্দ্র হবে। এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ৫০০-এর ওপর ভোট কেন্দ্রের নাম পেয়েছি। ৬ সেপ্টেম্বরের পর গেজেট হওয়ার পর বলতে পারব। চার নম্বর কাজ হচ্ছে কেনাকাটা, ব্যালট পেপার পৌঁছানো, স্ট্যাম্প প্যাড পৌঁছানোর কাজের টেন্ডার হয়ে গেছে। পোলিং পার্সোনালের প্যানেল তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। এটা কমপ্লিট হওয়ার পর প্রশিক্ষণ শুরু হবে।