এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার মাত্র দুই মাস আগে তড়িঘড়ি করে সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সন্দেহের চোখে দেখছে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। নির্বাচনের অল্প সময় আগে নির্বাচন কমিশনের এমন উদ্যোগের পেছনে দুরভিসন্ধি দেখছেন কোনো কোনো দলের নেতারা। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ সামনে রেখে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির ধারাবাহিক সংলাপেও অধিকাংশ দল ইভিএমের বিরুদ্ধে মত দেয়। ব্যাপক বিরোধিতা থাকায় নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছিল ইভিএম নিয়ে তাদের প্রস্তুতি নেই। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে কী এমন পরিস্থিতি হলো যে ইভিএম নিয়ে ইসিকে ভাবতে হচ্ছে- এমন প্রশ্ন সামনে আনছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোট মিত্র ১৪ দলের শরিক ছাড়া অন্য সব বিরোধী দল ইভিএমের বিপক্ষে।
এমনকি সরকারের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টিও ইসির এ উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখছে। দলটির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ জানিয়েছেন বুধবার দলীয় সভা থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানানো হবে। ইসি সূত্রে জানা গেছে, গত বছর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে অংশীজনদের সংলাপে ইভিএম ব্যবহার না করার ব্যাপারে ব্যাপকহারে সুপারিশ এসেছে। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। ২৩টি দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। পরবর্তীতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা জানিয়েছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ইসির নেই। সিইসির এ বক্তব্যের পরও সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের কারণে বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরে সন্দেহ সৃষ্টি হয়। সম্প্রতি ইসি ইভিএম ব্যবহারে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিলে এ সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়।
সরকারের বাইরে থাকা সকল রাজনৈতিক জোট সংসদের ভোটে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি সংসদে থাকা জাতীয় পার্টিও বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। শনিবার রাজধানীতে দলীয় এক অনুষ্ঠানে জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ বলেন, ইভিএমের ব্যাপারে জনমনে অনেক সন্দেহ রয়েছে। তাই এই ভোটিং পদ্ধতি চালুর আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। ইভিএম জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন কমিশনের ইভিএম নিয়ে তৎপরতা শুরুর পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মসূচিতে ইভিএমের বিরোধিতা করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্টও ইভিএমের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তফ্রন্ট নেতারা। তারা বলেন, নির্বাচন কমিশন ইভিএম কেনার ব্যাপারে তাড়াহুড়ো শুরু করেছে, এতে জনমনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে।
বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এ আহ্বান জানান। যুক্তফ্রন্ট নেতারা বলেন, সমপ্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ভারতে বিরোধী দল ইভিএমে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমেরিকা, হল্যান্ডসহ পৃথিবীর বহু দেশে ইভিএম ব্যবহার বাতিল করা হয়েছে। তারা আরো বলেন, ইভিএমে যান্ত্রিক দুর্বলতার সুযোগে ভোট নিয়ে অনায়াসে কারচুপি করা যায় বলেই বিভিন্ন দেশ এটা বাতিল করেছে। যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে ইভিএম সংগ্রহ করা এবং নির্বাচনে তা ব্যবহার না করার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। গত বুধবার রাজধানীতে এক সভায় বাম গণতান্ত্রিক জোটও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে। জাতীয় নির্বাচনে ইসির ইভিএম ব্যবহারের তোড়জোড় নিয়ে জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, যেখানে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে, সেখানে ইসির এ ধরনের পদক্ষেপ সন্দেহজনক। তিনি বলেন, মানুষের মনে এখন সন্দেহ জাগছে, সরকারি দলকে বাড়তি কোনো সুবিধা দিতে ডিজিটাল কারচুপির জন্য এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জোটের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতেও ইভিএমের বিরুদ্ধে জোটের অবস্থান জানানো হয়।
গতকাল বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে দলটির নেতারা ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে তাদেরও বিশ্বাস করতে পারছে না। তাই ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হয়ে ইভিএমের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাইছে। কিন্তু সামনের দিনে আন্দোলনের যে সুনামি আসবে তাতে ইভিএমসহ আওয়ামী লীগ সরকার ভেসে যাবে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন হারানো বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম গত বুধবার এক বিবৃতিতে বলেন, ইভিএম ব্যবস্থা অকার্যকর ও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণিত হওয়ায় বহু উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেই তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। ইভিএম ব্যবহারের অবাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। শুক্রবার ইভিএম পদ্ধতির সমালোচনা করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, ইভিএম পদ্ধতির মাধ্যমে যে কেউ জালভোট দিতে পারে। এটা পরীক্ষিত। এই জিনিস ভালো না। এটা মানুষ চায় না। এদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরো কয়েকটি ইসলামী দল ইভিএমের বিরোধিতা করে আসছে। গত বৃহস্পতিবার ইভিএমের বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের বিরোধিতা করে কমিশন সভা থেকে ওয়াক আউট করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ইভিএমের বিরোধিতা করার অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর অনীহার কথা উল্লেখ করে সভায় নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করেন। নোটে তিনি বলেছেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দলগতভাবে সংলাপকালে ইভিএম সম্পর্কে সরকারি দল ও প্রধান বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পর বিরোধী। এমতাবস্থায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অধিকতর আলোচনা ও সমঝোতার প্রয়োজন ছিল। তবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা জানিয়েছেন, ইভিএম নিয়ে ইসি প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভোটগ্রহণের কাজে ব্যবহার হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ইসি সূত্রে জানা গেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের কোথাও ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ নেই। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে মতামত নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসার চিন্তা নেই ইসির। কমিশনের কোনো সভায় সংলাপে বসার বিষয়ে আলোচনাও হয়নি। তবে সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীতে ইভিএম মেলার আয়োজন করছে কমিশন। ওই মেলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসির। ওই মেলায় রাজনৈতিক দলগুলো চাইলে মতামত দিতে পারবে।