এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : ফেসবুক রক্তখেকো এক ‘দানব’। সামাজিক এ নেটওয়ার্কটি বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের অন্যতম অস্ত্র। সম্প্রীতির পাশাপাশি দাঙ্গা-ফাসাদে উসকানি দেয়ার কাজেও হরহামেশাই ফেসবুকের ব্যবহার হচ্ছে। ঘৃণাত্মক বক্তব্য (হেট স্পিচ) ছড়িয়ে মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গা গণহত্যায় জোরালো ভূমিকা রেখেছে ফেসবুক। এ গণহত্যায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সরাসরি হাত থাকলেও কার্যত রোহিঙ্গা গণহত্যা পরিচালনার ‘মূল হোতা’ ছিল ফেসবুক। গত বছর রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরুর পর থেকে সংখ্যালঘু এ গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে বিদ্বেষ, হিংসা, ঘৃণা ছড়ানোর কাজে ফেসবুককে ব্যবহার করেছে উগ্র বৌদ্ধরা। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নীরবে সব দেখেছে, জেনেছে, বুঝেছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পরবর্তীকালে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপের মুখে নড়েচড়ে বসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটি। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। রক্তে লাল পুরো রোহিঙ্গা জাতি। হত্যার শিকার হাজার হাজার মানুষ। বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ নারী ও শিশু। সব দিক বিচার-বিশ্লেষণে সেনাবাহিনীর গণহত্যার চেয়েও ফেসবুক বড় অপরাধ করেছে বলে শুক্রবার এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।
গত বছরের আগস্ট মাসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিরাপত্তা তল্লাশির নামে সামরিক হামলা চালানো শুরু করে সেনাবাহিনী। হত্যা, ধর্ষণ-গণধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়ে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিগৃহীত ও নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংস উসকানি ছড়াতে গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ফেসবুক। ঘৃণ্য পোস্ট, অডিও-ভিডিও ছড়িয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের মনে হিংসা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন পক্ষ থেকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে কয়েকবার এসব তথ্য সামনে এনেছে। ২০১৫ সালের প্রথমদিকে এ ধরনের প্রথম প্রতিবেদেন দেয় রয়টার্স। নিউইয়র্কভিত্তিক ট্যাবলয়েড টাইম ম্যাগাজিনও বহুবার ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে ইমেইল করেছে। কিন্তু এ ধরনের কন্টেন্ট অপসারণে তেমন কোনো ব্যবস্থাই নিতে পারেনি মার্ক জাকারবার্গের এ প্রতিষ্ঠানটি। এ ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফেসবুক বারবার বলেছে, তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। দীর্ঘদিন তদন্তের পর গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংসহ ২০ জনের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দিয়েছে ফেসবুক। এটা একটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এখন কেন সেটা? কেন এত দেরিতে?
ফেসবুক ছেড়ে রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ভিকের দিকে ঝুঁকছেন মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধরা। দেশটির সেনাপ্রধানের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়ার পর ভিকেতে অ্যাকাইন্ট খুলেছেন তিনি। ইতিমধ্যে ভিকেতে তার অনুসারীর সংখ্যা ১৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফেসবুকে মিন অং হ্লাইংয়ের অনুসারী ছিল ২৮ লাখ। মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্সিয়াল উপদেষ্টা ইউ নায়ে জিন লাতও ফেসবুকে নিষিদ্ধ হওয়ার পর ভিকেতে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন। মাত্র ৫ হাজার অনুসারীর এ অ্যাকাউন্ট থেকে বিদ্বেষমূলক পোস্ট প্রচারের কারণে ৩০ আগস্ট তার ভিকে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাবিরোধী বার্তা ছড়ানোর অভিযোগে কট্টরপন্থী বৌদ্ধ ভিক্ষু ইউ উইরাথুর ভিকে অ্যাকাউন্টও বাতিল করা হয়েছে।
রাশিয়া মিয়ানমারের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র। তবুও হিংসা ও বিদ্রূপাত্মক প্রচারণাকে প্রশ্রয় দেয়নি দেশটি। অথচ ২৮ লাখ অনুসারীর মিয়ানমার সেনাপ্রধানের অ্যাকাউন্ট থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে হিংসা ছড়ানোর পরও কেন চোখ বুজে ছিল ফেসবুক? তাদের নজরে কি এসব আসেনি? এমন লাখ লাখ অনুসারী বিশিষ্ট প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গা নিধনের পক্ষে প্রচারণা ও মুসলিমবিরোধী বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু দেখেও না দেখার ভান করেছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।
ঘৃণ্য প্রচারণা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ফেসবুক দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকারকর্মীদের রোষানলে রয়েছে। শুধু মিয়ানমার নয়, ফেব্র“য়ারিতে শ্রীলংকায় ও গত বছরের সেপ্টেম্বরে জার্মানিতে দাঙ্গা ছড়ানোর পেছনেও ফেসবুকের ‘হাত’ ছিল।