এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন মহলের সংশয়-সন্দেহকে উড়িয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, নির্বাচন হবেই, কেউ বানচাল করতে পারবে না। এটা ঠেকানোর কারও কোনো শক্তি নেই। বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি তাদের দলীয় বিষয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনতেও যাব না, বাধাও দেব না। তবে, বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন তিনি। নেপালে বিমসটেক সম্মেলনে যোগদান শেষে দেশে ফেরার দু’দিন পর এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রোববার গণভবনে অনুষ্ঠিত এ সংবাদ সম্মেলন তিনি বিমসটেক সম্মেলনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। পাশাপাশি সমসাময়িক রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি।
গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল-বিকল্পধারার বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোটকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী। তবে, ড. কামাল নির্বাচন চান কিনা সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আদালতের বিষয় উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার দ্রুত মুক্তি চাইলে বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করতে পারে। অথবা আন্দোলনও করতে পারে। এছাড়া আগামী নির্বাচনে ইভিএম সীমিত পরিসরে ব্যবহার করা যেতে পারে বলেও মত দেন সরকারপ্রধান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি ব্যবহার করে মিয়ানমার সে দেশের নাগরিকদের ওপর অত্যাচারের মিথ্যা অপপ্রচার করাকে জঘন্য কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এতিমের টাকা চুরি করার দায়ে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে কারাভোগ করছেন। তাকে আমি বা সরকার গ্রেফতার করেনি। রাজনৈতিকভাবেও তাকে গ্রেফতার বা মামলা করা হয়নি। তার মামলা বর্তমান সরকার করেনি। করেছে খালেদা জিয়ার প্রিয় পাত্ররাই। এক-এগারোর সময় সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ, সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরীসহ অনেকেই খালেদা জিয়ার প্রিয়ভাজন ছিলেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যে মামলা চলেছে ১০ বছর, এ ধরনের মামলায় এতদিন লাগে না। সরকার যদি হস্তক্ষেপ করত এতদিন কি লাগত? উনি আদালতে আসতে চাইতেন না বলে এর শুনানিতে ১৫৪টা তারিখ পড়েছে। এখন বিএনপি বলছে তার মুক্তি ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না। অথচ তার মুক্তি সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়। আর যদি দ্রুত মুক্তি চায় বিএনপি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারে। এখানে আমাদের দোষ দিয়ে লাভটা কি? তাদের নেত্রী বন্দি হয়ে আছেন, তারা আন্দোলন করুক। ডাক দিচ্ছে, হুঙ্কার দিচ্ছে- খুব ভালো কথা। এখন বলছে নির্বাচন করবে না। নির্বাচন কে করবে কে না করবে, সেটা সেই দলের ওপর নির্ভর করে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। এখানে আমাদের কি করার আছে? তাদের দল যদি মনে করে, করবে না, করবে না। তারা যদি মনে করে, তাহলে করবে। এখানে তো আমাদের কোনো বাধা দেয়ার কিছু নেই বা দাওয়াত দেয়ারও কিছু নেই। পরিষ্কার কথা। তবে, যাই ঘটুক তাদের সঙ্গে বসব না। খালেদা জিয়ার ছেলে মারা যাওয়ার পরে যখন তার বাসায় দেখতে গেলাম। আমার মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। আমাকে ঢুকতে দিল না। সেদিন থেকেই তো আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি অন্তত ওদের সঙ্গে বসব না। আমার সঙ্গে কোনো আলোচনা হবে না। প্রশ্নই ওঠে না। এটা আপনারা যে যতই বলেন। ক্ষমতায় থাকি, না থাকি, আমার কিচ্ছু আসে যায় না। কিন্তু আমার একটা আত্মসম্মানবোধ আছে। এটা মনে রাখবেন। অপমানের একটা সীমা আছে। যারা দিনের পর দিন আমাদের বাড়িতে পড়ে থাকত, তারা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেয়ার মতো সাহস রাখে? আমি তখন তো রিঅ্যাক্ট করিনি। কিচ্ছু বলিনি। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ মারল। তখনই আমার অ্যারেস্ট করা উচিত ছিল। তখনও আমি সহনশীলতা দেখিয়েছি। কাজেই এটা বিএনপির সিদ্ধান্ত। তারা কি করবে না করবে।
শনিবার ঢাকায় এক সমাবেশে বিএনপি নেতারা বলেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং ভোটের তফসিল ঘোষণার আগে শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচনে অংশ নেবে না তারা।
বিএনপির নির্বাচনসংক্রান্ত বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, নির্বাচন সব রকম ব্যবস্থায় দেখেছি। একবার কেউ ক্ষমতায় বসলে, ক্ষমতা কেউ ছাড়তে চায় না। কেয়ারটেকার, মার্শাল ল- সবই তো দেখা হয়েছে। কোনোটিই কাজ করে না। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। সংসদ ভেঙে দেয়া হবে- এটা কোনো কথা না। উচ্চ আদালত থেকে রায় দিয়েছে অনির্বাচিত সরকার থাকতে পারে না। তবে সংসদ চাইলে ২ মেয়াদ রাখতে পারে। কিন্তু সংসদ চায়নি। ভারতে পার্লামেন্ট থাকে। নির্বাচন হয়, নতুন সদস্যরা দায়িত্ব নিলে আগের সংসদ অটো ভেঙে যায়। এখানেও সেভাবে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আরেক প্রশ্নের উত্তরে সরকারপ্রধান বলেন, নির্বাচন হবেই। নির্বাচন ঠেকানোর মতো কারও কোনো শক্তি নেই। কারণ এ দেশের মানুষ এখন জানে, একটা গণতান্ত্রিক সরকার থাকলে দেশের উন্নতি হয়। এটা মানুষ খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে। সেই সচেতনতাও আছে। তারপরও ষড়যন্ত্র আছে, ষড়যন্ত্র থাকবে। সেই ষড়যন্ত্রটা জনগণই প্রতিরোধ করেছে এবং করবেও। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতাকে যারা খুন করতে পারে, সে দেশে অনেক কিছুই সম্ভব। আমাকে খুন করার চেষ্টা করে সফল হয়নি, হয়তো একদিন সফল হতেও পারে। আমি সারাক্ষণ মৃত্যুমুখে থাকি। আর এটা জেনেই আমি বাংলাদেশে এসেছি। এটা জেনেই আমি রাজনীতি করে যাচ্ছি। গুলি-গ্রেনেড কত কিছু দিয়েই তো চেষ্টা হয়েছে। বিমানের নাট-বোল্ট খুলে গেল। কিন্তু আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দেন বারবার। নিশ্চয় কোনো কাজ করাতে চান। ভয়ে ভীত হয়ে ঘরে বসে থাকলে হবে না। আমাকে কাজ করতে হবে। আর মৃত্যু তো উপর আল্লাহর হাতে। আল্লাহ যখন লিখবে তখন মৃত্যু হবে। কিন্তু যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ দেশের জন্য কাজ করে যাব। আমি একটু সময়ও নষ্ট করতে চাই না। কারণ প্রতিটা সময় আমার দেশের মানুষের জন্য খুব মূল্যবান। তিনি বলেন, বৈরী পরিবেশ একদিকে খুনি, একদিকে রাজাকার, একদিকে যুদ্ধাপরাধীর মধ্যেও ক্ষমতায় এসেছি। সফলভাবে দেশ চালিয়ে দেশের উন্নয়ন করতে পেরেছি। আর এবার টানা ১০ বছর থাকার ফলে আজ উন্নয়নটা দৃশ্যমান এবং জনগণ তার সুফল পাচ্ছে। এতটুকু যে করতে পেরেছি, আমি তো তাতেই খুশি। অন্তত মানুষকে দেখাতে পেরেছি, এ দেশের উন্নয়ন করা যায়। যদি ইচ্ছা থাকে করতে পারে। তা আমরা পারি, আমরা সেটা প্রমাণ করে দিয়েছি। এখন সেটা নির্ভর করবে জনগণের ওপর।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমার কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই। বাংলাদেশের জনগণের ওপর আমার আস্থা আছে, বিশ্বাস আছে। হ্যাঁ, আমি চেয়েছিলাম দেশের উন্নতিটা করার। টানা দু’বার আমরা ক্ষমতায়। আজ উন্নয়নগুলো দৃশ্যমান। মানুষ তার সুফল ভোগ করছে। কাজেই মানুষ যদি এ সুফলটা অব্যাহত থাকুক চায়, একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়, আর উন্নতি চায়? আমার মানুষের ওপর এটুকু বিশ্বাস আছে যে তারা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আবার আমাদের জয়ী করবে এবং সরকার গঠন করতে দেবে। কেননা বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। জনগণকে বলব, যে কাজগুলো হাতে নিয়েছি, সেগুলো যাতে আমরা সম্পন্ন করতে পারি। কারণ আমরা সরকারে আসতে পারলে এগুলো সম্পূর্ণ করতে পারব। মানুষের জীবনমান আরও উন্নত হবে। আর না আসতে পারলে যারা আসবে তারা অতীতে যা করেছে এবারও তাই করবে। লুটপাট করবে, এতিমের টাকা মেরে খাবে, এতিমদের বিপদ আসবে। সবার জন্য বিপদ আসবে। সুদিন আসবে না, দুর্দিনই আসবে। সেটা সম্পর্কে আশা করি, জনগণ সচেতন থাকবে এবং আমাদের আবার ভোট দিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দেবে। জনগণ ভোট দিলে আছি, না দিলে নাই। কোনো আফসোস থাকবে না।
সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে একটি জোট গঠনের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে ওই জোটকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য সাধুবাদ জানানোর পাশাপাশি জোটের শরিকদের সম্পর্কে সরস মন্তব্য করেন তিনি। এ সময় ড. কামাল, বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মাহমুদুর রহমান মান্না এবং আ স ম আবদুর রব সম্পর্কে ছন্দ মিলিয়ে নানা কথা বলেন তিনি। ড. কামালের নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ সম্পর্কে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সরকারপ্রধান বলেন, ড. কামাল নিজে নির্বাচন চান কিনা, সেটা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। কামাল হোসেন ও গং কি নির্বাচন চান? অসাংবিধানিক গোষ্ঠী ক্ষমতা নিলে তো তারা একটি পতাকা পাবেন, ক্ষমতা পাবেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও চক্রান্ত করা হয়েছিল। ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের কথা বলা হয়। কোনো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে সংবিধানেই বলা আছে, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণার কথা।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতির জনকের আসন থেকে ড. কামাল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই তিনিই আবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বিরুদ্ধে কথা বলেন, নিজেকে সংবিধান প্রণেতা বলে দাবি করেন, যে সংবিধান তিনি নিজেই মানতে চান না। আসলে তারা মুখে গণতন্ত্রের কথা বলেন কিন্তু চর্চাটা হল অগণতান্ত্রিক পথে কোনোভাবে যদি ক্ষমতায় যাওয়া যায়।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আন্দোলনে বিশ্বাস করি। যদি ড. কামাল হোসেন আন্দোলনের কথা বলেন, তাহলে তিনি পরিকল্পনা নিয়ে বসে আছেন। আর যদি কেউ আন্দোলন করেন, উনি চান তারা যেন সফল হোক, আর যদি উত্তরপাড়া থেকে কেউ আসেন তাহলে ওনারা সাফল্য অর্জন করবেন, এটাই তো? ওনারা তো সুষ্ঠু গণতন্ত্র চান না। তারা বসেই আছেন, উত্তরপাড়ার (ক্যান্টনমেন্ট) দিকে তাকিয়ে। তাদের খায়েশ দেশ অস্থিতিশীল হলে তাদের কদর বাড়ে, পতাকা পায়। তারা এখন জোট করেছেন ভালো কথা। সাধুবাদ জানাই। রাজনৈতিক জোট হোক, নির্বাচনে সবাই আসুক, কনটেস্ট করুক। আর নির্বাচন অবাধ-নিরপেক্ষ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ জনগণের ভোট চুরি করতে তো আসিনি। কিন্তু ড. কামালের পকেটে তো সবসময় টিকিট থাকে। যখন বেশি গরম বক্তব্য দেবে ধরে নেবেন, বিমান রেডি আছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, বিকল্পধারা এখন স্বকল্পধারা। অথচ তার পরিবারের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক ছিল। একই প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের সমালোচনাও করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘সময়ে নীরব, অসময়ে সরব, তার নাম আ স ম রব।’ এ সময় নানা কথার সূত্র ধরে ওই জোটের শরিক নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মান্না এক সময় আমাদের দলে (আওয়ামী লীগ) ছিলেন। তিনি বেশ ভালো লেখেন। যখন আওয়ামী লীগে এলেন, আমি বললাম, যখন অন্য দল করতেন তখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বেশি বেশি লিখতেন। তো এখন আমাদের পক্ষেও কিছু লেখেন। একথা শুনেই মান্না, জুড়ে দেয় কান্না।’
মিয়ানমারের অপপ্রচার জঘন্য কাজ : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রকাশিত একটি বইয়ে ভুয়া ছবি প্রকাশ করে যেভাবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপপ্রচার চালানো হয়েছে, তাকে ‘জঘন্য কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মিয়ানমার যা করেছে অত্যন্ত জঘন্য। নিজেরাই নিজেদের সম্মান নষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে নিজেরাই নিজেদের অবস্থান খারাপ করেছে।
রোহিঙ্গা সংকটের ‘আসল সত্য’ প্রকাশের ঘোষণা দিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জুলাইয়ে একটি বই প্রকাশ করে, যেখানে তিনটি ভুয়া ছবি ব্যবহার করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পর দুই বাংলাদেশির লাশ উদ্ধারের একটি ছবি ব্যবহার করে সেনাবাহিনীর বইয়ে ক্যাপশনে বলা হয়েছে- সেটা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হাতে নিহত স্থানীয় বৌদ্ধদের ছবি। বিমসটেক সম্মেলনে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের সম্মেলনে সাধারণত দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আনা হয় না। তবে রিট্রিট সেশনে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। তিনি স্বীকার করেছেন যে, আমাদের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে, বলেছেন, তারা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। এছাড়া থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও আমি কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ কখনও চায়নি প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো সংঘাতপূর্ণ অবস্থা তৈরি হোক। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আমরা সব সময় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। মিয়ানমার কখনও আপত্তি করে না। বলে নিয়ে যাবে। বাস্তবতা হল- তারা বলে, কিন্তু করে না। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বইয়ে রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভুয়া ছবি দিয়ে অপপ্রচার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, তারা ছবিটা নিয়ে যেটা করল, এটা আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের এখানেও কিন্তু এরকম হয়েছে। প্রশ্নটা হল- এরা শিখল কার কাছ থেকে। ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি জোটের আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া ছবি আসার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্মরণ করাতে চাই, জামায়াত-বিএনপি মিলে এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছিল।
ইভিএম সীমিত আকারে ব্যবহার করা যেতে পারে : বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের পরীক্ষামূলক ব্যবহারের পক্ষে মত দেন। তিনি বলেন, এটা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। কারণ এটা প্র্যাকটিসের ব্যাপার। আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ইভিএমে ভোট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই হয়। ইভিএম চালুর জন্য আমি সব সময় পক্ষে ছিলাম। এখনও পক্ষে আছি। আমরা চাচ্ছি, কিছু কিছু জায়গায় শুরু হোক, সীমিত আকারে এটা চলুক। প্রযুক্তির কোনো সিস্টেম লস হয় কিনা, সেটা দেখা যাক। সেটা হলে সঙ্গে সঙ্গে বাতিল করা হবে। এটা এমন নয় যে, এটাই শেষ কথা। আমরা প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত আকারে শুরু করতে পারি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অংশ হিসেবে নতুন প্রযুক্তিতে ভোট হতেই পারে।
বিএনপির ইভিএম দিয়ে কারচুপি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি পাল্টা অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, কারচুপি করতে পারবে না বলে বিএনপি ইভিএমে আপত্তি জানাচ্ছে। কারণ তাদের জন্মটাই কারচুপির মাধ্যমে। কারচুপির তাদের কি একটা কৌশল আছে যা আমরা এখনও ধরতে পারিনি। কারচুপির জন্য প্রচুর টাকা ও নানা কৌশল বিএনপি ব্যবহার করে। তারা আবার কারচুপির কথা বলে। ইভিএম হলে সেই কারচুপিটা করতে পারবে না। একটার বেশি ভোট দিতে পারবে না, সিল মারতে পারবে না- সেজন্য তারা আপত্তি জানাচ্ছে। এটা স্পষ্ট। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইভিএমের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, সবচেয়ে সুবিধা হল, যে মানুষটা যাচ্ছে, একটা টিপ দিয়ে ভোট দিয়ে আসছে এবং সঙ্গে সঙ্গে রেজাল্টটা পেয়ে যাচ্ছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভোটে যে কারচুপির রাজনীতি, সেটা জিয়াউর রহমানই প্রথম এনেছে এ দেশে। কারণ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে, সেটাকে বৈধ করতে চেয়েছেন তিনি। আজ বিএনপি যখন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে তাদের জন্ম (প্রতিষ্ঠা) নিয়ে খোঁজ করা উচিত। কোথায়, কিভাবে হয়েছে দেখুক। তাদের জন্মের সূত্রটা, লগ্নটা মনে করুক। শুভ না অশুভ লগ্ন নিয়ে তারা জন্ম নিয়েছে। খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটের কথা যদি কারও মনে থাকে, তারা কী করেছিল। ঘোষণা দিয়েছিল দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী। ১৫ দিনও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জনগণ চাইলে তো থাকতে পারত। কারচুপি করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল বলে বাধ্য হয়েছিল পদত্যাগ করতে।
ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য ইসি ইতিমধ্যে নির্বাচনী আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। এক-তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের একটি পরিকল্পনার কথা প্রকাশ পেলেও সিইসি বলেছেন, তারা এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি। ইসির আকস্মিক পদক্ষেপের পর থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম ইভিএম নিয়ে। বিএনপি এর বিরোধিতা করে বলেছে, ভোটে ‘ডিজিটাল কারচুপি’ করতে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে খবরের গুরুত্বে নিজের অবস্থান তিন, চার বা পাঁচ নম্বরে থাকে মন্তব্য করে এ নিয়ে খেদ প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বেসরকারি টেলিভিশন দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি টেলিভিশন আগে ছিল না, আমিই দিয়েছি। অথচ সেই টেলিভিশনে তাদের (বিএনপি) ফেভার করে, আমাকে রাখে চার-পাঁচ নম্বরে। তিনি বলেন, ‘তারা (বিএনপি) পার্লামেন্টে নেই, তারা বৈধ বিরোধী দলেও নেই। অথচ আমাদের মিডিয়ার কাছে বিএনপিই বিরোধী দল, তারাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আজ কিছু কিছু রিপোর্ট পড়ছিলাম। তাদের (বিএনপি) আমলে যে দুর্নীতি, ঘুষ নেয়া, আন্তর্জাতিকভাবেও বহু কাহিনী রয়েছে। তবে তাদের সৌভাগ্য যে, মিডিয়া সব সময় তাদের ফেভার করে। আমি তো থাকি আপনাদের প্রত্যেকটা টেলিভিশনের হয় তিন নম্বর, নয় চার বা পাঁচ নম্বরে।
ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ : আগামী নির্বাচনে তার দলের ইশতেহারে নতুন কি চমক থাকছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ১০০ বছরে কোন পর্যায়ে যাবে সেই পরিকল্পনা চলছে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়া আসলে দেশের উন্নয়ন হবে না। সে লক্ষ্যে ২০১০ থেকে ২০, ২০২১ থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত করণীয় অনেকদূর এগিয়েছে। ৪১ থেকে ১০০ পর্যন্ত কী হবে সেই পরিকল্পনাও দিয়ে যাচ্ছি। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। দেশ এগিয়ে যাবে। বদ্বীপকে রক্ষা ও উন্নয়ন ত্বরান্বি^ত করতেই ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ হাতে নেয়া হচ্ছে। জাতির জনকের স্বপ্ন বাস্তবায়নই আমার ইচ্ছা। আর কিছু চাই না।
সংবাদ সম্মেলনে মঞ্চে প্রধানমন্ত্রীর একপাশে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আরেক পাশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী বসা ছিলেন। এছাড়া দর্শক সারিতে আওয়ামী লীগ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।