এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। কে এ নির্বাচনে অংশ নিল কিংবা কে নির্বাচন বর্জন করল- এসবের দিকে তাকিয়ে না থেকে এখন থেকেই পুরোদমে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি এককভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগেকার সিদ্ধান্ত বহাল থাকলেও জোট করার পথও খোলা রেখেছে তারা। তবে জোট হলে তা হতে হবে সম্মানজনকভাবে, ন্যায্য হিস্যা আদায় করে। আগ বাড়িয়ে কারও সঙ্গেই জোটভুক্ত হওয়ার প্রস্তাব দেবে না জাতীয় পার্টি। বুধবার বনানীর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয় রজনীগন্ধায় অনুষ্ঠিত দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্যদের যৌথসভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়। পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এতে সভাপতিত্ব করেন। বিরোধীদলীয় নেতা ও পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ, কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারসহ দলের শীর্ষ নেতারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দলের সঙ্গেই জোট করা হোক না কেন, ন্যায্য হিস্যা আদায় করেই তা গঠন করার জন্য দলীয় চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতি অনুরোধ জানান রওশন এরশাদসহ পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ সদস্যরা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার আগে শতবার চিন্তা করে বুঝে-শুনে আসন সমঝোতাসহ ক্ষমতায় গেলে কিভাবে সরকার গঠিত হবে এবং এ সরকারে জাতীয় পার্টির অবস্থান কি হবে- এসব বিষয়ে আগেভাগেই ফয়সালা করার জন্য হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
আরও জানা গেছে, বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমরা কারও কাছে সিট চাইব না, মন্ত্রীর সংখ্যাই বা আমরা কেন চাইব। আমরা বিরোধী দল বা সরকারের অংশীদার হওয়ার জন্য তো রাজনীতি করছি না। রাজনীতি করছি ক্ষমতায় গিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। এবার আমরা সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করব। এককভাবে নির্বাচন করব। তবে নির্বাচনী রাজনীতিতে জোটও করা যায়। অন্যরাও করে। কিন্তু আমরা কারও সঙ্গে আগ বাড়িয়ে জোটে যাওয়ার কথা কেন বলব? কেউ যদি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমাদের অংশীদার হতে চায়, তাহলে তারাই আমাদের সঙ্গে জোটে আসবে। আমরা কেন যাব?’ আমরা কারও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হব না।
রওশন এরশাদের বক্তব্যের জবাবে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, ‘রওশনের বক্তব্যে আমি খুশি হয়েছি, উৎসাহিত হয়েছি। আমরা এবার নিজেরাই রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করব।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন হলে আরও বৃহৎ জোট করব। তবে এটা নিশ্চিত, এবার ন্যায্য হিস্যা আদায় করেই জোটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
সভার শুরুতেই জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, দেশের মানুষ লাঙ্গলে ভোট দিয়ে এরশাদ সাহেবকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য অপেক্ষায় আছেন। এজন্য সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের নির্বাচনী মাঠে নেমে পড়তে হবে। তিনি আগামী দেড় মাসের মধ্যেই ৩০০ সংসদীয় আসনের সবক’টি কেন্দ্রে কমিটি ও পোলিং এজেন্ট নিয়োগ করে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। এর আগে জাতীয় পার্টির শাসনামলের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়, যা আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রচারণায় ব্যবহার করার কথা জানানো হয়।
সভায় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জাতীয় মহিলা পার্টির সভানেত্রী এবং সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি বলেন, জাতীয় পার্টিকে বাদ দিয়ে বা উপেক্ষা করে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এটাই সত্যি। তাই আর বসে না থেকে এখন থেকেই পুরোদমে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি বলেন, ‘তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথমদিনে এক লাখ মানুষ মারা যাবেন। তো দ্বিতীয় দিনে কতজন মারা যাবেন তা তিনি বলেননি। তবে আমরা চাই কোনো মানুষ মারা না যান। আর এজন্য জাতীয় পার্টির ক্ষমতায় আসা ছাড়া উপায় নেই।’
আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি বলেন, এরশাদ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া জোটের রাজনীতি যে ‘বিগ জিরো’ তা দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতা যেমন ভালো করে জানেন, তেমনি সাধারণ মানুষও জানেন। তাই জাতীয় পার্টি আর এরশাদ ছাড়া তথাকথিত বড় কোনো দলের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
দলীয় সংসদ সদস্য পীর মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করলে তারা আমাদের ছেড়ে দেয়া আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দেয়। এবারও তা করতে পারে, তাই তাদের সঙ্গে জোট করার আগে বুঝে-শুনে করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় পার্টির এক নেতা বলেন, তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যেই ক্ষমতায় আসতে চাইবে, তাদের জাতীয় পার্টির সহায়তা প্রয়োজন হবে। তাই অন্যদের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখে নির্বাচনে যাবে দলটি। যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করে তাহলে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে জাতীয় পার্টি। আর বিএনপি নির্বাচনে এলে প্রয়োজনে জোট গঠন করবে তারা। সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গঠন করা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দুই মতই বৈঠকে উঠে আসে। দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য সভায় বলেন, আওয়ামী লীগ বারবার বেইমানি করেছে। যেখানেই তারা লাঙ্গলকে আসন ছেড়ে দিয়েছে, সেখানেই তারা গোপনে প্রার্থী দিয়েছে। তাই আমরা নিজেরা নিজেদের মতো নির্বাচন করব।
পরে আগামী নির্বাচন নিয়ে দলের বিভিন্ন পরিকল্পনার বিষয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। এ সময় জানানো হয়, আগামী নির্বাচনে যারা মনোনয়ন চাইবেন, তাদের ৪০ হাজার টাকাসহ আবেদন জমা দিতে হবে। টাকা না দিলে মনোনয়নের জন্য আবেদন করা যাবে না। মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়লে মনোনয়ন বোর্ড সাক্ষাৎকার নিয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যোগ্যতাসহ সবকিছু যাচাই-বাছাই করে প্রার্থী চূড়ান্ত করবে।
সভায় আরও জানানো হয়, ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর বসুন্ধরা কনভেনশন হলে দলীয় কর্মীদের নির্বাচন নিয়ে ডিজিটাল প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেছেন, সেগুলো নিয়ে প্রচার চালানোর বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। বৈঠকে ঢাকা-১৭ আসন থেকে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়েও প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় বলা হয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ থেকেই জনসংযোগ শুরু করবেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
এদিকে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম এবং সংসদ সদস্যদের যৌথ সভায় এখন থেকেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩০০ আসনেই নির্বাচন করার প্রস্তুতি নেয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সভায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে কোনো দল অংশগ্রহণ করুক বা না করুক সেদিকে জাতীয় পার্টি ফিরে তাকাবে না। তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, জাতীয় পার্টি অন্য কোনো দলের ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে আর ব্যবহৃত হবে না। আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পার্টি নিজেরাই ক্ষমতায় যাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাবে। তার জন্য সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। সভায় যেসব জেলায় জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে সেখানে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই সম্মেলন সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় বলা হয়, নির্বাচনের জন্য উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে কমিটি গঠন বাদেও ভোট কেন্দ্রভিত্তিক কমিটিও গঠন করতে হবে। ৮ সেপ্টেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভায় পার্টির কর্মসূচি অবহিত করা হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সভার শুরুতে চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সাইফুল্লাহ আল মুনিরের উপস্থাপনায় ‘পল্লীবন্ধুর হাত ধরে আর একবার’ শিরোনামে নির্বাচনে জাতীয় পার্টির করণীয় ও কর্মকৌশল সম্পর্কিত তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
সভায় উপস্থিত ছিলেন- পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বেগম রওশন এরশাদ এমপি, কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের, মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এমপি, এমএ সাত্তার, কাজী ফিরোজ রশীদ এমপি, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু এমপি, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, মো. হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়া টিপু, আলহাজ সাহিদুর রহমান টেপা, শেখ মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, ফখরুল ইমাম এমপি, মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী এমপি, সৈয়দ মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, হাবিবুর রহমান, সুনীল শুভরায়, এসএম ফয়সল চিশতী, মীর আবদুস সবুর আসুদ, মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী, মো. আজম খান, মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, সোলায়মান আলম শেঠ, আতিকুর রহমান আতিক, নাসরিন জাহান রতনা এমপি, আবদুর রশীদ সরকার, মেজর মো. খালেদ আখতার (অব.), মুজিবুর রহমান সেন্টু, আলহাজ সফিকুল ইসলাম সেন্টু, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি।
সংসদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ এমপি, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এমপি, একেএম মোস্তাফিজুর রহমান এমপি, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম মিলন এমপি, মো. নোমান মিয়া এমপি, আলহাজ শওকত চৌধুরী এমপি, নুরুল ইসলাম ওমর এমপি, সালাউদ্দিন মুক্তি এমপি, ইয়াইয়াহ্ চৌধুরী এমপি, মুনিম চৌধুরী বাবু এমপি, পীর ফজলুর রহমান এমপি, মো. আলতাফ আলী এমপি, মো. আমির হোসেন ভূঁইয়া এমপি, হাজী মো. ইলিয়াস এমপি, সেলিম ওসমান এমপি, মো. রুস্তম আলী ফরাজী এমপি, অধ্যাপক ডা. মো. আক্কাছ আলী সরকার এমপি, মেহজাবিন মোর্শেদ এমপি, মেরিনা রহমান এমপি, খোরশেদ আরা হক এমপি, সাহানারা বেগম।