এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার শুনানিতে ন্যায়বিচার নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময় তিনি বিচারকের উদ্দেশে বলেন, ‘এই আদালত চলতে পারে না। এই আদালতে কি বিচার হবে, আমার জানা হয়ে গেছে। আমি খুবই অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন, পা ঝুলিয়ে না রাখতে। কারণ আমার পা ফুলে গেছে। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। এ অবস্থায় আদালত চলতে পারে না। আপনার যতদিন ইচ্ছা সাজা দিন। আমি বারবার এভাবে আদালতে আসতে পারব না। আমি কতটা অসুস্থ তা জানার জন্য রক্তের ডাক্তারি রিপোর্ট দেখেন। তিনি বলেন, সাজাই তো হবে, ন্যায়বিচার নাই এখানে।’ বুধবার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারের ভেতরে ঢাকার পঞ্চম জজ আদালতের বিচারক ড. মো. আক্তারুজ্জামানের অস্থায়ী এজলাসে শুনানিকালে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। এই বিচারকই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন। এজলাস থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গেও নিজের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলেন খালেদা জিয়া। এ সময় তিনি আদালত পরিবর্তনের বিষয়ে ইঙ্গিত করে বলেন, ৭ দিন আগে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা (সরকার ও প্রসিকিউশন) জানে। কিন্তু আমার আইনজীবীরা কিছুই জানেন না। তাদের আদালতে আসতে দেয়া হয়নি। সিনিয়র আইনজীবীদের ছাড়া শুনানি হতে পারে না। আমার শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি ধীরে ধীরে প্যারালাইজড হয়ে যাচ্ছি। এখানে ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দুপুর ১২টা ১২ মিনিটে হুইল চেয়ারে করে কারাগারের বিশেষ কক্ষে বন্দি খালেদা জিয়াকে নিয়ে আসেন মহিলা পুলিশ ও কারারক্ষীরা। এ সময় তার ব্যক্তিগত কাজের লোক ফাতেমাও এক বোতল পানি নিয়ে খালেদা জিয়ার পাশে এজলাসে দাঁড়িয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার পরনে ছিল গোলাপি রঙের শাড়ি ও ওড়না। শরীরের ওপর জড়ানো ছিল সাদা রঙের চাদর। পায়ে ছিল সাদা জুতা। তাকে বেশ কয়েকবার টেবিলে রাখা টিসু দিয়ে মুখ মুছতে দেখা যায়।
খালেদা জিয়া এজলাসে প্রবেশের আগেই কারাগারের ভেতরে পুরনো প্রশাসনিক ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে তার জন্য একটি চেয়ার ও সামনে একটি টেবিলের ব্যবস্থা রাখা হয়। এজলাস লাল কাপড়ে মুড়ে বিচার কাজের জন্য প্রস্তুত করা হয়। বিচারকের চেয়ারের বাঁ পাশে তৈরি করা হয়েছে আসামির কাঠগড়া। তার সামনে সাদা কাপড়ে মোড়া টিটেবিল আর একটি চেয়ার। উল্টোদিকে সাক্ষীর কাঠগড়া। আর সামনে প্রসিকিউশনের বসার ব্যবস্থা। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বসার জায়গা হয়েছে বিচারকের মুখোমুখি। আর এজলাসের সামনে ছিল পেশকারের বসার জায়গা। বকশীবাজারের বিশেষ আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানির সময় খালেদা জিয়া নির্দিষ্ট চেয়ারটিতে বসতেন। কিন্তু বুধবার তাকে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসতে দেখা যায়নি। তিনি হুইল চেয়ারেই বসেছিলেন পুরো সময়। তার পক্ষে যেসব আইনজীবী মামলায় আইনি লড়াই করেন, তাদের কেউ কারাগারের অস্থায়ী আদালতে যাননি। তবে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান এজলাসে উপস্থিত ছিলেন। ওই সময় তিনি আদালতকে জানান, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা গেজেট না পাওয়ায় আদালতে আসতে পারেননি।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে এখানে এসেছি।’ খালেদা জিয়াকে তার সঙ্গে একান্তে কিছুক্ষণ কথা বলতে দেখা গেছে। পরে তিনি খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়েও কথা বলেন।
আইন মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার বিচারিক আদালত স্থানান্তরের গেজেট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, নিরাপত্তাজনিত কারণে বকশী বাজারের আলীয় মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত এ মামলার (মামলা নং ১৮/২০১৭) বিচার কাজ পুরনো কারাগারের প্রশাসনিক ভবনে অস্থায়ী আদালতের ৭নং কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার গেজেটের পর বুধবার পূর্বনির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী অস্থায়ী আদালতে শুনানির আয়োজন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারাগারেই আরেকটি ভবনের দোতলার একটি কক্ষে গত ৭ মাস ধরে বন্দি রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ৮ ফেব্রুয়ারি একই বিচারক তাকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেন।
বুধবার শুনানির জন্য সকাল ১০টা থেকেই প্রস্তুত ছিলেন দুদকের পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল, ঢাকা মহানগর আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু ও অতিরিক্ত পিপি শাহ আলম তালুকদারসহ প্রসিকিউশনের আইনজীবীরা। আদালতের চারদিক নিরাপত্তা বাহিনী ঘিরে রাখে। এভাবে বেলা গড়িয়ে দুপুর ১২টা পেরিয়ে গেলেও খালেদা জিয়া কিংবা তার আইনজীবীদের দেখা নেই। ফলে বিচারকও এজলাসে আসছেন না। এক সময় দুদকের পিপি মোশাররফ হোসেন কাজল যুগান্তরকে বলেন, খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বকশী বাজারের আদালতে যেতে পারেন কিন্তু এখানে আসতে পারেন না। তা কি করে হয়। আমি নিজে মঙ্গলবার রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়ার কাছে লোক মারফত গেজেটের কপি পাঠিয়েছি। এখন তারা যদি বলেন গেজেট পাননি। আমরা আর কি বলব।
এরপর দুপুর ১২টা ১২ মিনিটে বিচারক এজলাসে ওঠেন। আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে প্রথমে বক্তব্য দেন দুদকের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল। মামলার সর্বশেষ পরিস্থিতি এবং নতুন করে আদালতের স্থান নির্ধারণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন তিনি। তিনি আদালতকে জানান, এ মামলায় প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। মামলার দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের মধ্যেই প্রায় ৯ মাস ধরে শুনানি বন্ধ রয়েছে। এ অবস্থায় পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের এ স্থানে অস্থায়ী আদালত ঘোষণা করা হয়েছে। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আসামি খালেদা জিয়ার আইনজীবীর কাছে প্রজ্ঞাপনের কপি পাঠানো হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবেও তাদের ফোন করে জানিয়েছি। এছাড়া মিডিয়ার মাধ্যমে সবাইকে অবহিত করা হয়েছে। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা এখন আদালতে উপস্থিত নেই। এ অবস্থায়ই বিচার কার্যক্রম শুরু করতে আদালতের কাছে আর্জি জানান তিনি। এ ছাড়া আসামি মুন্না ও মনিরুলের কাছে জানতে চান তাদের আইনজীবীরা কোথায়।
এ সময় বিচারক বলেন, আমি দেখতে পাচ্ছি খালেদা জিয়া ছাড়াও দু’জন আসামি এজলাসে রয়েছেন। তাদের পক্ষে জামিনের কোনো দরখাস্ত পাইনি। তিনি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দুই আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না ও মনিরুল ইসলাম খানের কাছে জানতে চান তাদের আইনজীবীরা এসেছেন কিনা। জবাবে তারা বলেন আসেননি। তখন বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিত হওয়ার জন্য বিচার কাজ ১ ঘণ্টা বিরতি দিয়ে এজলাস ত্যাগ করতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা খান দাঁড়িয়ে বলেন, মাননীয় আদালত ১ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিলেও আইনজীবীরা আসতে পারবেন না। কে কোথায় আছে। এছাড়া তারা জানেন না এখানে আদালত বসেছে। খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তিনি আর বসে থাকতে পারছেন না। আদালতের পরিস্থিতিও ‘বিচার কার্যক্রম শুরুর মতো নয়’ মন্তব্য করে গোলাম মোস্তফা বলেন, ৫০ ফুট বাই ২০ ফুটের এ ছোট জায়গার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। আইনজীবীসহ সবার বসার জায়গা সেভাবে নেই। পরে সুবিধাজনক সময়ে ও জায়গায় বিচার কার্যক্রম চালানো হোক। গোলাম মোস্তফা খান আরও বলেন, প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে রাতে। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা কেউ আদালত স্থানান্তরের বিষয়ে অবহিত নন। এ কারণে তারা সবাই বকশীবাজারের আদালতে গেছেন। আমি একজন অবজারভার হিসেবে এখানে এসেছি। আর আমাদের সবার ফোন বাইরে রেখে দেয়া হয়েছে। এখান থেকে যোগাযোগ করাও সম্ভব না। একজন অবজারভার হিসেবে আমার মনে হয়, তারিখ পেছানোই যৌক্তিক হবে।
বিচারক আখতারুজ্জামান তখন বলেন, প্রজ্ঞাপন তো কাল জারি হয়েছে। আর মামলার ডেট তো আগেই ছিল। তারিখ পেছাতে হলেও তো আইনজীবীদের পিটিশন লাগবে। এ সময় কোনো আসামির আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় এবং তাদের সঙ্গে ‘যোগাযোগ সম্ভব না’ বলে শুনানির নতুন তারিখ নির্ধারণের কথা বলেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি।
পরে বিচারক ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারণ করে তিন আসামির জামিন বাড়ানোর জন্য আবেদন জমা দিতে বলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের পর খালেদা জিয়াকে একদিনও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানিতে হাজির করা হয়নি। প্রায় প্রতি তারিখেই কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে তার অসুস্থতার কথা জানিয়ে আসছে। ফলে এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানিও সাত মাস ধরে হচ্ছে না। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে- খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় সরকারের কোনো আন্তরিকতা নেই। গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে তার চিকিৎসার দাবিও করে আসছেন দলের নেতারা। বিএনপি কারাগারে আদালত বসানোর এই সিদ্ধান্তকে ‘সংবিধান পরিপন্থী’ আখ্যায়িত করে তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতীকী অনশনের কর্মসূচি দিয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিএনপির এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়।
কারাগারে যাওয়ার পর সর্বশেষ গত এপ্রিলে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউতে নেয়া হলে খালেদা জিয়াকে প্রকাশ্যে দেখা গিয়েছিল।
এদিকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের অস্থায়ী আদালতে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার শুনানিকে কেন্দ্র করে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কারাগারের সামনের সড়কে যান চলাচল ও আশপাশের দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়। মোতায়েন করা হয় বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। প্রস্তুত রাখা হয় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আদালতের কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। চতুর্দিকে কাঁটাতারের বেড়া দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সড়ক দিয়ে যাওয়া প্রত্যেক পথচারীর শরীর তল্লাশি করা হয়।
সকালে বিএনপির আইনজীবীরা বকশীবাজার আদালত চত্বরে আসেন। কারাগারের ভেতরে খালেদা জিয়ার শুনানির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেন। ওই সময় অ্যাডভোকেট মাহমুদ পারভেজ বলেন, কারাগারে শুনানি হবে- এমন নোটিশ আমরা পাইনি। আদালত হবে প্রকাশ্যে, সেখানে আইনজীবীসহ গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত থাকবেন। এই শুনানি আমরা বয়কট করছি। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে খালেজা জিয়াকে মোকাবেলা করতে না পেরে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারের ভেতরে শুনানি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে ৩ কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুদক। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশীদ আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ অভিযোগ গঠনের পর শুরু হয় বিচার। মামলার অন্য আসামিরা হলেন খালেদার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী এবং হারিছের তৎকালীন একান্ত সচিব (বর্তমানে বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক) জিয়াউল ইসলাম মুন্না, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।