এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর মামলায় জাবালে নূরের মালিকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে। তবে চার্জশিটে হোতাদের নাম নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্তের সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার নিয়োগ দেয়ার হোতাদের বিষয়ে জানতে পারলেও তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। আর চার্জশিটে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার ধারায় না দিয়ে লঘু সাজার ধারায় দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
বৃহস্পতিবার আদালতের সংশ্লিষ্ট শাখায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক কাজী শরিফুল ইসলাম চার্জশিট দাখিল করেন। দণ্ডবিধির ২৭৯, ৩২৩, ৩২৫, ৩০৪ ও ৩৪ ধারায় এ চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপর ঢাকা মহানগর হাকিম কায়সারুল ইসলাম চার্জশিট ‘দেখিলাম’ মর্মে স্বাক্ষর করেন।
চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন- জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাসের মালিক শাহাদাত হোসেন ও জাহাঙ্গীর আলম, দুই চালক মাসুম বিল্লাহ ও জুবায়ের সুমন এবং দুই বাসের দুই সহকারী এনায়েত হোসেন ও কাজী আসাদ। তাদের মধ্যে শাহাদাত হোসেনের মালিকানাধীন বাসটির চাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। কাজী আসাদ ও জাহাঙ্গীর আলম পলাতক রয়েছেন। অপর দুই আসামি রিপন হোসেন ও সোহাগ আলীর অব্যাহতি চাওয়া হয়েছে।
চার্জশিটে বলা হয়, যাত্রী ওঠানোর জন্য জাবালে নূর পরিবহনেরই দুটি গাড়ি প্রতিযোগিতা শুরু করে কার আগে কে যাবে। একপর্যায়ে একটি বাসের চালক মাসুম বিল্লাহ ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ১৪-১৫ জন ছাত্রছাত্রীর ওপর উঠিয়ে দেয়। এতে ঘটনাস্থলে দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। ঘটনার আগে বাস দুটি দু-তিনবার ওভার ট্রেকিং করে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
আদালত ও তদন্ত সূত্র জানায়, চার্জশিটে আসামিদের ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত না করে ৩০৪ ধারায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত করা হলে মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে চিহ্নিত হতো এবং এ ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া সম্ভব হতো। মামলায় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার পরিবর্তে ৩০৪ ধারায় আসামিদের অভিযুক্ত করায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার মতে এটি দুর্ঘটনা। আর কোনো দুর্ঘটনা ইচ্ছাকৃত হয় না। জবানবন্দিতে ঘাতক চালক স্বেচ্ছায় গাড়ি চাপা দেয়ার কথা উল্লেখ করলেও এটা পূর্বপরিকল্পিত না। তাই ৩০৪ ধারায় আসামিদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় শাস্তির বিধানে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি খুনের অপরাধ করলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। অন্যদিকে, ৩০৪(খ) ধারার শাস্তির বিধানে বলা আছে- কোনো ব্যক্তি বেপরোয়া যান চালিয়ে বা অবহেলার মাধ্যমে যান চালিয়ে কারও মৃত্যু ঘটালে দায়ী চালককে তিন বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘এই মামলাটিকে আসামিদের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযুক্ত করার মতো উপাদান ছিল। এর আগে তাজরীন গার্মেন্ট কিংবা রানা প্লাজার ঘটনাকেও দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু সেগুলো হত্যা মামলা হিসেবেই বিচার হচ্ছে। এ ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই হওয়ার কথা ছিল।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘটনা গৎবাঁধা তদন্তের বিষয় নয়। মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না বা দৈব-দুর্বিপাক এমন ঘটনাগুলোকে দুর্ঘটনা বলা যায়।
কিন্তু এটা তো তেমন ঘটনা নয়। সে ক্ষেত্রে এটা হত্যা মামলাই হওয়ার কথা। সেটা না হয়ে চার্জশিটে দুর্ঘটনা মামলা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। এ মামলার অধিকতর তদন্ত হওয়া উচিত।’
জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন যুগান্তরকে বলেন, রমিজ উদ্দিনের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার মামলার তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। অপরাধীরা যথাযথ শাস্তি পাবেন বলে আশা করি। ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি তুলে দিয়ে মৃত্যু ঘটানোর পরও কেন তাদের বিরুদ্ধে ৩০২ ধারা আনা হল না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩০২ ধারাটি আসবে না।
৩০৪ ধারাটি যাবজ্জীবনের সাজা। ৩০২ ধারার সাজা মৃত্যুদণ্ড। কারণ ৩০২ ধারার জন্য তদন্তে যে আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো আসা দরকার তা পাওয়া যায়নি। পূর্বপরিকল্পনা এবং নিশ্চিত মৃত্যু অনুযায়ী হত্যার পরিকল্পনা থাকতে হতো। কিন্তু তদন্তে তা পাওয়া যায়নি। যার কারণে ৩০২ ধারায় চার্জশিট আনা হয়নি।
৩০৪ যথাযথ ধারায় চার্জশিট প্রদান করা হয়েছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে ইচ্ছাকৃত ছাড়া যদি হতো সে ক্ষেত্রে ৩০৪(খ) ধারা পড়ত। সেটি হলে সাজা তিন বছর হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
যেহেতু ইচ্ছাকৃত করেছে তাই সবার বিরুদ্ধেই ৩০৪ ধারায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে। এতে যাবজ্জীবন সাজা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘দুই বাসের মালিক ও ড্রাইভার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মালিক বলেছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই, তারা জেনেই তাদের নিয়োগ করেছেন। এতে তার অপরাধ হয়েছে। কারণ তাদের প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স ছিল। এটা দিয়ে কখনোই বড় বাস চালাতে পারে না তারা।’
গত ২৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর হোটেল র্যাডিসনের বিপরীত পাশের জিল্লুর রহমান উড়ালসেতুর ঢালের সামনের রাস্তার ওপর জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বাস রেষারেষি করতে গিয়ে একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের ওপর উঠে পড়ে। এতে দুই শিক্ষার্থী নিহত ও নয়জন আহত হন। নিহত দুই শিক্ষার্থী হল দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র আবদুল করিম রাজিব (১৭) ও একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী দিয়া খানম মিম (১৬)। এ ঘটনায় নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানমের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানায় মামলা করেন।
উল্লেখ্য, ২ আগস্ট গ্রেফতারকৃত জাবালে নূরের মালিক শাহাদত হোসেনকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। রিমান্ড আবেদনে তিনি আদালতকে বলেন, শাহাদত হোসেন জাবালে নূর কোম্পানির সভাপতি মো. জাকির হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নোমান ও ডিএমডি অলি আহম্মদের বাসটি চালানোর জন্য নিয়মবহির্ভূতভাবে উপযুক্ত চালক না দিয়ে অনুপযুক্ত চালক মো. মাসুম বিল্লাহকে নিয়োগ দেন।
এ কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। মামলার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে অনুপযুক্ত ড্রাইভার নিয়োগ চক্রের সদস্যদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ এবং গ্রেফতারের লক্ষ্যে আসামি শাহাদত হোসেনকে ১০ দিনের রিমান্ড প্রয়োজন। তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এরপর আর কোনো তথ্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি।
জানতে চাইলে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি আবু বকর ফরহাদ যুগান্তরকে বলেন, যেহেতু তদন্ত কর্মকর্তা আদালতকে জাবালে নূর কোম্পানির সভাপতিসহ অন্যদের জড়িত থাকার কথা জানিয়েছেন।
সেহেতু তাদেরও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত ছিল। লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভার যারা নিয়োগ করেন তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন ছিল।
জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার হান্নানুল ইসলাম বলেন, বাস চালকদের ডিফেন্সমূলক বক্তব্য ছিল। আমরা তদন্তে এমন কিছু পাইনি।