এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে একের পর এক মামলা দেয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ মামলা দেয়া হচ্ছে আজগুবি ঘটনার ওপর ভিত্তি করে। ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশকে মারধর করার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি অথচ মামলার এজাহারে এসব কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
মৃত ব্যক্তি, ৮৬ বছরের প্যারালাইসড রোগী, এমনকি হজ ও চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে থেকেও মামলার হাত থেকে রেহাই পাননি অনেকে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, ঢাকা মহানগর বিএনপি, অঙ্গসংগঠনের কমিটিসহ মহানগর, জেলা-উপজেলা এমনকি ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি ধরে মামলা দিচ্ছে পুলিশ।
গত কয়েকদিনে পল্টন, খিলগাঁও, মতিঝিল থানায় পুলিশের কাজে বাধা দেয়া, ককটেল বিস্ফারণসহ নাশকতার কয়েকটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, রেজাক খান, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা সানাউল্লাহ মিয়া, শহিদুল ইসলাম বাবুলসহ তিন শতাধিক নেতাকর্মীর নাম ধরে আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামিও আছে অনেক। পল্টন থানায় করা মামলায় ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এমন মামলায় কেন্দ্রীয় নেতাদের আসামি করার ঘটনায় বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিএনপি নেতা ও বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলকে চাপে রাখতেই এ ধরনের আজগুবি মামলায় ভুতুড়ে আসামি দেয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। তবে তড়িঘড়ি কারণ ছাড়া মামলা দায়েরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলে তারা মনে করেন।
তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট ঘটনায় মামলা হচ্ছে এবং কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আমরা কাউকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করি না। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেফতার করা হচ্ছে। গ্রেফতার নিয়ে বিএনপির অভিযোগ মিথ্যা। বিএনপির যেসব ব্যক্তি গ্রেফতার হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। এসব অভিযোগের ভিডিওচিত্র আছে।
তিনি বলেন, তারা যদি কোনো গ্রেফতার নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারব, কী অভিযোগে ধরা হয়েছে। নিরপরাধ কাউকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না।
বুধবার খিলগাঁও থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলা দায়ের করা হয়। এ মামলার এজাহারে খিলগাঁও থানাধীন দক্ষিণ বনশ্রী আল-রাজি হাসপাতালের সামনে বেআইনিভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর আক্রমণ এবং কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। এ মামলায় ৫টি বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ উদ্ধার দেখানো হয়েছে। মামলাটির বাদী হয়েছেন খিলগাঁও থানার এসআই আমিনুল ইসলাম।
১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় ২টি মামলা হয়েছে। এ মামলায় ৭২ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে ককটেল বিস্ফোরণ, পুলিশের কাজে বাধা দেয়া এবং নাশকতার অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু ওইদিন বায়তুল মোকাররম এলাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে মতিঝিল থানায় মামলা দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার এ দুই নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয় বলে জানা গেছে। এ মামলায় আরও আসামি করা হয়েছে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আমিনুল হক, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক সানাউল্লাহ মিয়াসহ নাম উল্লেখ করে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে।
এছাড়া এসব মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যাও অনেক। পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত মতিঝিল থানায় এ বিষয়ে মোট সাতটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় তিনশ’ নেতাকর্মীকে।
দীর্ঘদিন থেকে গুরুতর অসুস্থ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের নামেও পুলিশ নাশকতার মামলা দিয়েছে। অথচ তিনি শয্যাশায়ী। অন্যের সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে চলাচল করা সম্ভব নয়। রাজধানীর পল্টন থানায় তরিকুল ছাড়াও কেন্দ্রীয় নেতাদের নামে মামলা হয়েছে বলে জানান দলটির সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু। টিপুকেও এ মামলার আসামি করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কোথাও কোনো ঘটনা না ঘটলেও আমাদের নামে মামলা দেয়া হয়েছে। কারণ, সরকার একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে। সব মামলাই হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, মামলাগুলো ভুয়া। কারণ ১১ ও ১২ তারিখের ঘটনা দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। ১২ তারিখ আমি খালেদা জিয়ার চ্যারিটেবল মামলায় জেলখানার আদালতে ছিলাম। ওখানে সব মিডিয়ার লোকেরা আমাকে দেখেছেন। সেখান থেকে কিভাবে ককটেল মারলাম কিছু বুঝলাম না।
এ ধরনের মামলা ও গ্রেফতার প্রসঙ্গে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিগত উপজেলা নির্বাচনে আমরা নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন দেখেছি। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে মামলা দিয়ে তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রেখেছে। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। কিন্তু একজন অপরাধ না করেও আজগুবি ঘটনায় মামলার আসামি হবেন এটা ভাবা যায় না। এটা বৈধ ক্ষমতা অবৈধভাবে ব্যবহারে সরকারের একটা প্রবণতা। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকে দলীয়করণ করার বিষয়ও স্পষ্ট হচ্ছে। এমন হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থাও কমে যাবে।
তিনি বলেন, এ কারণেই আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি। নিরপেক্ষ সরকার হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, পহেলা সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে সারা দেশে শুরু হয় গ্রেফতার অভিযান। এসব অভিযানের আগেই নেতাকর্মীদের নামে থানায় মামলা করে রাখা হয়েছে। আবার শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করা হলেও সেখানে অগ্নিসংযোগ ও পুলিশকে মারধরের কারণ দেখিয়ে দেয়া হচ্ছে মামলা।
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানায় ৫ সেপ্টেম্বর করা ১৩ নম্বর মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই রাতে কামরাঙ্গীরচরে রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মীরা ইট-পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করে এবং লাঠিসোটা দিয়ে মেরে পুলিশকে আহত করেছে।
এ ঘটনায় নুরুল ইসলামকে ৩১ নাম্বার আসামি করা হয়েছে। অথচ তিনি ৩১ আগস্ট মারা গেছেন। স্বজনরা তাকে ওই দিনই আজিমপুরের পুরনো কবরস্থানে দাফন করেছেন। চকবাজার থানার প্রয়াত নেতা আজিজুল্লাহকেও ৫ সেপ্টেম্বর এক মামলায় আসামি করা হয়েছে। অথচ তিনি মারা গেছেন ২০১৬ সালের মে মাসে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী জানান, কারণ ছাড়াই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে গায়েবি মামলা করা হয়েছে। এ গায়েবি মামলার সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে নামে-বেনামে প্রায় তিন লাখ নেতাকর্মী। গ্রেফতার করা হয়েছে সাড়ে তিন হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৯০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন সরকারি দলের নাগালের মধ্যে রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপিকে দমন করতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এজন্য আজগুবি মামলায় ভুতুড়ে আসামি করা হচ্ছে। মৃত, ব্যক্তি, হজ পালনরত ব্যক্তিরা মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
আরও জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন থানা ছাড়াও কুমিল্লার মুরাদনগর, ফেনীর ছাগলনাইয়া, বগুড়া, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় আজগুবি ঘটনায় ভুতুড়ে আসামির সন্ধান মিলেছে। বিএনপির দফতর সূত্রে জানা গেছে, কুমিল্লার মুরাদনগরের আহাদ খলিফা থাকেন বাহরাইনে। গত বছরের অক্টোবরে তিনি সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন।
চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি বাহরাইনে ফিরে যান তিনি। তবে ৮ সেপ্টেম্বর মুরাদনগর থানায় ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ৩৩ আসামির মধ্যে তিনিও একজন। ১ সেপ্টেম্বর ফেনীর ছাগলনাইয়া থানায় পুলিশ বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। মামলার এজাহারভুক্ত আসামি উপজেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক আজাদ হোসেন। তিনি হজ পালনের জন্য ১৮ জুলাই সৌদি আরব যান। ফিরেছেন ৪ সেপ্টেম্বর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক তাজমেরী এসএ ইসলাম বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এ ছাড়া উত্তরায় থানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. মোরশেদ হাসান খান ও প্রকৌশলী আ ন হ আকতার হোসেনের বিরুদ্ধেও একই থানায় মামলা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আজহারুল ইসলাম মান্নান হজ পালন করে যেদিন দেশে ফেরেন, সেদিনই তার ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা করা হয়।
গাজীপুর জেলা বিএনপি নেতা কাজী সাইয়েদুল আলম ছেলের চিকিৎসার জন্য সোমবার সকাল ৮টায় সিঙ্গাপুর যান। ওইদিন বেলা ১১টায় শহরে বিএনপির মানববন্ধনে লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যানবাহন ভাঙচুর করে নেতা-কর্মীরা। এ ঘটনায় রাতে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এ মামলায় আসামি করা হয় সাইয়েদুল আলমকে।
৭ সেপ্টেম্বর বগুড়ার ধুনট থানায় বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে নাশকতার মামলা করে পুলিশ। এতে আবদুল খালেক সরকার (৮৬) নামের প্যারালাইসড রোগীকে আসামি করা হয়। তার বয়স দেখানো হয় ৩৮। আবদুল খালেক সরকার উপজেলার নিমগাছী ইউনিয়নের নান্দিয়ারপাড়া গ্রামের মৃত মোবারক আলী সরকারের ছেলে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ এনে ১০ দিনের মধ্যে চার মামলায় ১৯২ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করে পুলিশ। যে ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তখন আসামিদের কেউ ওই এলাকায় ছিলেন না। এতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার, নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির, মুস্তাফিজুর রহমান ভুইয়া দিপু, মাহফুজুর রহমান হুমায়ুন, জেলা ছাত্রদল নেতা আমিরুল ইসলাম ইমনকে আসামি করা হয়। এই চার মামলায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাজশাহীর তানোর থানায় ৩ সেপ্টেম্বর ৩০ জনকে আসামি করে একটি নাশকতার মামলা দায়ের করে পুলিশ। এ মামলায় জামালউদ্দিন নামে একজনকে আসামি করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে হজ পালনে সৌদি আরব অবস্থান করছেন।
খুলনা জেলা যুবদল নেতা ফয়সাল গাজী ভারতে চিকিৎসাধীন। ২৯ আগস্ট তিনি ভারত যান। এর তিন দিন পর ২ সেপ্টেম্বর ১১ জনের বিরুদ্ধে দাকোপ থানায় মামলায় করা হয়। এ মামলায় ফয়সালও আসামি।