এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : আগের কিস্তিতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জাতশত্রুর পরিচয় কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। এবার বলব তাঁদের মধ্যকার রেষারেষির গল্প। রেষারেষির বদলে প্রতিশোধ বললে শব্দটি জুতসই হয়। কারণ, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সাবেক সহকর্মীর একতরফা প্রতিশোধের তোড়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল সের্গেই স্ক্রিপালের।
গত মার্চ মাসে হামলার শিকার হয়েছিলেন সের্গেই স্ক্রিপাল ও তাঁর মেয়ে ইউলিয়া স্ক্রিপাল। যুক্তরাজ্য পুলিশের দাবি, বাবা-মেয়ের ওপর নার্ভ এজেন্ট নোভিচক ব্যবহার করা হয়েছিল। বিবিসি বলছে, নোভিচক এজেন্টের স্রষ্টা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে তৈরি করা হয়েছিল নোভিচক। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যাওয়ার এত দিন বাদে ফের আলোচনায় নোভিচক। আর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে রাশিয়াকে।
সম্প্রতি রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। যুক্তরাজ্য যে দুই রুশ ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হামলাকারী বলছে, সরাসরি সাক্ষাৎকারে তাঁরা নিজেদের ‘পর্যটক’ বলে দাবি করেছেন। পুতিনের কথাতেও একই সুর।
বিবিসি বলছে, এই সাক্ষাৎকার প্রচার করে নিজের দেশের মানুষের কাছে ও আন্তর্জাতিক বিতর্কের মঞ্চে সুবিধা নিতে চাইছে রাশিয়া। কিন্তু এটি আরও কিছু প্রশ্ন উসকে দিয়েছে। কেন ওই দুই সন্দেহভাজন রুশ নাগরিক দু-তিন দিনের জন্য বেড়াতে গেলেন? যুক্তরাজ্যের এত দর্শনীয় স্থান থাকতে কেন সলসবুরিকেই বেছে নিলেন তাঁরা? যুক্তরাজ্যের পুলিশের দাবি, আলেক্সান্ডার পেতরভ ও রুসলান বশিরভ নামের এই দুই সন্দেহভাজন ব্যক্তি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন। এখন সরাসরি সাক্ষাৎকারে তাঁদের দাবি, এটিই তাঁদের সত্যিকারের পরিচয়! অথচ তাঁদের পেশা ও অতীত জীবনের বৃত্তান্ত কোথায়?
এই প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর দেয়নি ক্রেমলিন। নিন্দুকেরা বলছেন, এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে আগ্রহীও নয় রাশিয়া। কারণ, তাতে গুমর ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, সন্দেহভাজনদের দাবি করা তথ্যকে ‘হাস্যকর’ বলে অভিহিত করেছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। বলেছেন, ‘এসব মিথ্যা টিভি শো বন্ধ করার সময় এসেছে। বিশ্ব বুঝে গেছে রাশিয়ে এতে জড়িত।’
এ তো গেল চলমান বিতর্কের হালনাগাদ খবর। এবার বরং দুই সাবেক কেজিবি কর্মকর্তার বিপরীতমুখী যাত্রার গল্প শুরু করা যাক।
কারও পৌষ মাস কারও সর্বনাশ
২০০৬ সালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরপরই সের্গেই স্ক্রিপাল চলে গিয়েছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরিবারের সদস্যরাও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ খুব একটা পেতেন না। স্ক্রিপালের পরিজন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, একঘরে হয়ে গিয়েছিল স্ক্রিপালের পরিবার। প্রতিবেশীদের মধ্যে চলছিল কানাঘুষা। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে থেকেই গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা স্ক্রিপালকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তুলে নেওয়ার আসল কারণ বলা যাচ্ছিল না প্রতিবেশীদের। অনেকে মনে করছিলেন, স্ত্রী লিদুমিলাকে ছেড়ে অন্য কোনো নারীতে মজেছেন সের্গেই স্ক্রিপাল!
সের্গেই আটক হওয়ার পর থেকে স্ত্রী লিদুমিলা নানাভাবে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। কেজিবির সাবেক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তদবির করেছিলেন। লিদুমিলার প্রশ্ন ছিল, স্ক্রিপালের মতো আরও অনেকেই তো সোভিয়েত ভাঙনের পর পশ্চিমামুখী হয়েছিলেন। বাকিদের কেন ধরা হচ্ছে না? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
মুদ্রার অন্য পিঠ তখন ঝলকাচ্ছে। সের্গেই স্ক্রিপালের সাবেক সহকর্মী ভ্লাদিমির পুতিন বনে গেছেন রাশিয়ার সর্বেসর্বা। পুতিনের মিত্রদের বেশির ভাগই ছিলেন সেন্ট পিটার্সবার্গের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক হয়ে যান তাঁরা। পুতিনের বন্ধুরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ছত্রচ্ছায়ায় ধীরে ধীরে বিশ্বের শীর্ষ ধনীতে পরিণত হতে থাকেন। তাঁরা কিনতে থাকেন প্রাসাদসম বাড়ি, পানিতে ভাসতে কেনেন প্রমোদতরি!
ঠিক এই সময়টাতে লিদুমিলাকে ঘুরতে হচ্ছিল মানুষের দরজায় দরজায়। কার্যত ভিক্ষায় নেমেছিলেন তিনি। সঞ্চয় যা ছিল, সবই শেষ। কারাগারে থাকা স্বামীকে মাসিক বরাদ্দটুকু পাঠাতেও নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। সাবেক সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সের্গেই স্ক্রিপালের যে পেনশন পাওয়ার কথা ছিল, তাও তখন অনিশ্চিত। শেষে সরকারের কাছে অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর যৎসামান্য অর্থ পেয়েছিলেন লিদুমিলা। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা ছিল ঢের কম। ওই সময়ে আর নিজেকে নিয়ে ভাবছিলেন না তিনি। স্বামী ও ছেলেমেয়েদের নিয়েই ছিল তাঁর সব চিন্তা। নিজেকে নিয়ে ভাবলে দুশ্চিন্তা আরও বাড়ে। লিদুমিলার দেহে তখন বাসা বেঁধেছে ক্যানসার।
সুচিকিৎসার অভাবে লিদুমিলার সারা শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছিল। দিন দিন তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন মৃত্যুর দিকে। ওদিকে স্ক্রিপাল দম্পতির একমাত্র ছেলে সাশা বাবার কারণে বেকার হয়ে পড়েন। বাবার মাধ্যমে সামরিক গোয়েন্দা কার্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র ব্যবহার করেই কিছু কাজকর্ম পেতেন সাশা। সের্গেই স্ক্রিপাল দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর সেই ক্ষোভ এসে পড়ে ছেলের ওপর। বেকার অবস্থায় চরম হতাশায় পড়েন সাশা, অতিরিক্ত মদ্যপান শুরু করেন। ধরা পড়ে কিডনি জটিলতা। গত বছর মাত্র ৪৩ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
যেভাবে মুক্তি স্ক্রিপালের
ডবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালকে বাঁচাতে একপর্যায়ে তৎপর হয়ে ওঠে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ২০১০ সালের দিকে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় রাষ্ট্রপতি পদ ছেড়ে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন ভ্লাদিমির পুতিন। প্রেসিডেন্ট পদে আসেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। বলা হয়ে থাকে, মেদভেদেভ কিছুটা পশ্চিমাঘেঁষা। আর এই সুযোগ কাজে লাগাতেই তৎপর হয়ে ওঠে সিআইএ ও এমআইসিক্স।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ ও রাশিয়ার বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে দর-কষাকষি শুরু হয়। দাঁড়িপাল্লার একদিকে ছিল যুক্তরাষ্ট্রে গোপনে কার্যক্রম চালানো ১০ জন রুশ গুপ্তচর। আর অন্য পাল্লায় ছিল সের্গেই স্ক্রিপালসহ চারজন। সেই সময়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টায় ছিল রাশিয়া। দুইয়ে দুইয়ে মিলে হয়ে গেল চার! শুরু হয়ে যায় গুপ্তচর বিনিময়ের গোপন বাণিজ্য।
ওই বছরের জুলাইয়ের এক রৌদ্রতপ্ত দিনে রাশিয়ার জরুরি পরিস্থিতিসংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের উড়োজাহাজে চেপে ভিয়েনায় পৌঁছান সের্গেই স্ক্রিপাল। ডবল এজেন্ট স্ক্রিপাল তখন মুক্ত মানুষ।
জাতশত্রুকে কতটুকু ঘৃণা করেন পুতিন?
২০১২ সালে ফের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন পুতিন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেদভেদেভের গলাগলি ভালো লাগেনি তাঁর। আবার প্রেসিডেন্ট হয়েই মেদভেদেভের নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপের গতিপথ বদলে দেন পুতিন। তত দিনে অবশ্য স্ক্রিপালরা চলে গেছেন পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার কবজায়।
সের্গেই স্ক্রিপালসহ চারজনকে পশ্চিমাদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনায় ভ্লাদিমির পুতিন বেজায় নাখোশ হয়েছিলেন। ওই বিনিময়ের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে পুতিন বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ সারাটা জীবন দেশের পেছনে ব্যয় করল এবং এরপর কিছু জারজ সন্তান এল এবং তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল।’ রাগান্বিতভাবে পুতিন আরও বলেন, ‘এই লোকগুলো কীভাবে নিজেদের সন্তানের চোখের দিকে তাকাবে? শুয়োর একেকটা। এই কাজের বিনিময়ে তারা যা পেয়েছিল, বিশ্বাস করুন, সেগুলোতেই তাদের দম বন্ধ হয়ে আসবে।’
পুতিনের ক্রোধ টের পাচ্ছেন? বিশ্বাসঘাতকদের কেমন ঘৃণা করেন পুতিন, বুঝতে পারবেন পরের লাইনগুলোয়। পুতিন ওই সময় জানিয়েছিলেন, বিশ্বাসঘাতকদের মৃত্যু যদি নাও হয়, তবু ভোগান্তি এড়াতে পারবে না। পুতিন বলেছিলেন, ‘তাদের পুরো জীবনটা লুকিয়ে রাখতে হবে। অন্য কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলার যোগ্যতা তাদের নেই, ভালোবাসার মানুষেদের সঙ্গেও না। জানেন তো, যেসব ব্যক্তি এ ধরনের ভাগ্য বেছে নেয়, তাদের ভবিষ্যতে হাজারবার আফসোস করতে হয়।’
কিন্তু ছাড়া পাওয়া চার সাবেক রুশ গুপ্তচরকে কি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন পুতিন? নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবই দিয়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেছিলেন, ‘অবশ্যই’। পুতিন কি তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চান? সংবাদ সম্মেলনে করা এমন প্রশ্নের রহস্যময় উত্তর দিয়েছিলেন বর্তমান রুশ প্রেসিডেন্ট। পুতিন বলেছিলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। তারা তাদের নিজস্ব নিয়মে চলে এবং গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা সবাই এসব নিয়ম ভালোভাবেই জানে।’
পুতিনের মনোবাসনা কী, তা বুঝতে এরপরও যদি অসুবিধা হয়, তবে গোয়েন্দা সংস্থার কাহিনি নিয়ে তৈরি হলিউডের যেকোনো অ্যাকশন ছবি দেখে নিতে পারেন।
স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টা কেন?
স্বামীর মুক্তির ২ বছর ৩ মাস পর ২০১২ সালে ক্যানসারে ভুগে মারা যান লিদুমিলা। এর পাঁচ বছর পর মারা যান স্ক্রিপাল দম্পতির একমাত্র ছেলে সাশা। যুক্তরাজ্যে বসত গাড়া সের্গেই স্ক্রিপাল তখন চরম মনঃকষ্টে। আপনজন বলতে বেঁচে ছিলেন মেয়ে ইউলিয়া। স্ক্রিপালের মেয়ে মস্কোতেই ছিলেন। হত্যাচেষ্টার কিছুদিন আগে বাবার কাছে এসেছিলেন।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, সের্গেই স্ক্রিপাল অনেক গোপন তথ্য জানতেন। এ কারণেই তাঁকে মুক্ত করেছিল পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্সের বিভিন্ন গোপন অ্যাসাইনমেন্টে নিয়মিতই অংশ নিতেন স্ক্রিপাল। রাশিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কে ইউরোপ ও আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ধারণা দিতেন সের্গেই স্ক্রিপাল। স্পেনের গুপ্তচর সংস্থা সিএনআইয়ের সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা ছিল তাঁর। যেতেন এস্তোনিয়া, চেক রিপাবলিকসহ নানা দেশে।
সের্গেই স্ক্রিপালের সব অ্যাসাইনমেন্টের দেখভাল করত যুক্তরাজ্য সরকার। স্বাভাবিকভাবেই এই বিষয়ে মুখ খোলেনি তারা। স্ক্রিপাল ঠিক কী ধরনের তথ্য দিয়ে সহায়তা করতেন, সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
মস্কোভিত্তিক রেডিও স্টেশন ‘এখো মস্কোভি’। স্ক্রিপাল ইস্যু নিয়ে নিয়মিত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রেডিও স্টেশনটির প্রধান সম্পাদক আলেক্সেই এ. ভেনেডিকটভ বলেন, স্ক্রিপালের মতো গুপ্তচরেরা সাবেক হওয়ার পর কখনো দেশের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন না—এটিই অলিখিত শর্ত বা নিয়ম। এর বিনিময়েই তাঁদের মুক্তি। কখনোই নিজেদের সামরিক দক্ষতা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবেন না তাঁরা।
এই সাংবাদিকের পরের কথায় স্পষ্ট কেন সলসবুরিতে পাওয়া গেছে সোভিয়েত আমলের নার্ভ এজেন্ট। আলেক্সেই এ. ভেনেডিকটভ বলেন, ‘স্ক্রিপাল কি করেছিলেন? এটি নিশ্চিত, তিনি নিয়ম ভেঙেছিলেন।’