এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : পরিবেশ দূষণজনিত মৃত্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে বাংলাদেশ। পরিবেশ দূষণগত কারণে ২০১৫ সালে শুধু শহরাঞ্চলেই মারা গেছেন ৮০ হাজার ২৯৪ জন মানুষ। এর মধ্যে বায়ূ দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় ৪৬ হাজার এবং পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য বিধিসংক্রান্ত কারণে মারা যান প্রায় ৩৪ হাজার মানুষ।
ওই বছরে শুধু ঢাকা শহরে মারা গেছেন ১৭ হাজার ৮৯৭ জন। এর মধ্যে বায়ু দূষণে মারা যান প্রায় ১০ হাজার, পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের ‘এনহ্যান্সিং অপারচুনেটিস ফর ক্লিন অ্যান্ড রিজেলিয়েন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ : কান্ট্রি ইনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস-২০১৮’ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়।
প্রতিবেদনটি ঢাকা, পাবনা ও কক্সবাজার শহরে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে সারা বিশ্বে পরিবেশ দূষণগত কারণে মৃত্যু হয়েছে ১৬ শতাংশ মানুষের।
আর বাংলাদেশে ২৮ শতাংশের। শুধু তাই নয়, একই সময়ে দেশের শহরাঞ্চলে পঙ্গুত্ববরণসহ নানা ক্ষতির শিকার হয়েছেন ২৬ লাখ ২৭ হাজার ৯২৬ জন। এক্ষেত্রে শুধু ঢাকা শহরে ক্ষতির শিকার হয়েছেন ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮১ জন।
এসব কারণে ১ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতি হয়েছে ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। এটি ওই বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। শুধু ঢাকা শহরেই আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সে বছর দূষণগত কারণে যেসব মানুষ মারা গেছেন, তাদের মধ্যে বায়ূ দূষণের ক্ষেত্রে পারিপার্শিক বায়ু দূষণে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এবং আবাসস্থলে বায়ূ দূষণে প্রায় ১৬ হাজার মানুষ মারা গেছেন।
এছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন ৪ হাজার ৮০০ জন, পরোক্ষ প্রভাবে ৯৬৬ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে প্রায় ১০ হাজার এবং পেশাগত পরিবেশ দূষণে মারা গেছেন প্রায় ১৯ হাজার মানুষ।
ঢাকার হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ শহরে পারিপার্শ্বিক বায়ূ দূষণজনিত কারণে মারা যান প্রায় সাড়ে ৬ হাজার এবং আবাসস্থলের বায়ূ দূষণে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মানুষ।
এছাড়া পানি, স্যানিটেশন এবং অস্বাস্থ্যগত বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রভাবে মারা গেছেন প্রায় ১ হাজার, পরোক্ষ প্রভাবে প্রায় ২০০ জন, পানিতে আর্সেনিকের কারণে ২ হাজার ২০০ এবং পেশাগত দূষণে মারা গেছেন প্রায় ৪ হাজার ২০০ ব্যক্তি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৪০ বছরে ঢাকা শহরে সুউচ্চ ভবন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ৭৫ শতাংশ চাষযোগ্য জমি হারিয়ে গেছে। এছাড়া নন-কমপ্লায়েন্স শিল্প ও অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ফলে শহরের বাতাস এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানি দূষিত হচ্ছে।
পাবনার মতো ছোট শহরেও ৫০ শতাংশের মতো জমি হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে বায়ু দূষণের ফলে প্রতি বছর মোট জিডিপির এক শতাংশ হ্রাস পাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন বড় ও ছোট উভয় ধরনের শহরের ওপর প্রভাব রাখছে।
জলাভূমি ভরাট করে বিভিন্ন এলাকায় বহুতল বাড়ি বানানোর কারণে শহরের বিভিন্ন অংশ বন্যার সময় প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ছোট ছোট নগরগুলো পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। ১৯৯০ সাল থেকে পাবনা তার অর্ধেক জলাভূমি হারিয়েছে। মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে রয়েছে ইছামতি নদী।
প্রতিবেদনে অবৈধ দখল রোধ এবং জলাভূমি ও খালগুলোতে বিনিয়োগ এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকা ও অন্যান্য শহরে এখনই ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুর অঞ্চলের রামচন্দ্রপুর খালটি সংস্কারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
আবাসন পল্লীগুলোর আবর্জনা ও অবৈধ দখলে গভীরতা হারানো এ খালটিকে ঢাকার পানিবাহিত রোগের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খালটি নাব্য হারানোর কারণে ২-৩ দিনে সামান্য বৃষ্টিতে এ অঞ্চলের বালুর মাঠে ১০-১২ দিন পানি জমে থাকে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দূষণ ও পরিবেশগত ঝুঁকির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। একটি উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে অবস্থান অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে এখনই বিশেষ করে শহর এলাকায় পরিবেশগত অবনতি ও দূষণ রোধে কাজ করতে হবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দূষিত পানি নদী বা খালে গিয়ে পড়ে। যা রাজধানীর আশপাশের এলাকার দরিদ্র মানুষের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের সময় বলা হয়, জলাভূমি দখল ও বিপজ্জনক বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে ফেলাসহ দূষণ ও পরিবেশগত অবনতির ফলে নারী, শিশু এবং দরিদ্রদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। প্রায় ১০ লাখ দরিদ্র মানুষ সিসা দূষণের ঝুঁকিতে রয়েছেন।
এ কারণে বিশেষ করে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে (আইকিউ) ও অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। বৃহত্তর ঢাকায়, ভারি ধাতব দূষিত স্থানগুলোর অধিকাংশই দরিদ্র এলাকাগুলোতে অবস্থিত।
প্রতিবেদনে তিনটি ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে পরিবেশগত অবনতির মূল্য, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই শহর, এবং পরিচ্ছন্ন শিল্প প্রসারের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এক্ষেত্রে বলা হয়েছে, নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়াও দেশে সবুজ অর্থায়ন, পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তির প্রসার, বিপজ্জনক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উন্নতকরণ এবং পরিবেশগত সুরক্ষার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করা করতে হবে।
প্রতিবেদনে দূষণের উৎস সম্পর্কে একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পানি দূষণ হচ্ছে ৮৩ শতাংশ, শব্দ দূষণ ১ শতাংশ, বায়ু দূষণ ২ শতাংশ, বিবিধ দূষণ ১০ শতাংশ, পানির উৎস ভরাট ১ শতাংশ এবং পাহাড় কাটার কারণে ৩ শতাংশ পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক প্র্যাকটিস ম্যানেজার কেসেনিয়া লভভস্কি বলেন, পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব। কেননা আমরা মাধবদীতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার সাফল্য দেখেছি। সেখানে দেখা গেছে, নগর পরিকল্পনায় স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগ, সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং দৃঢ় মনোবলের স্থানীয় নেতৃত্ব অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দূষণের ধারা পাল্টে দিতে পারে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে ৫৮ শতাংশ বায়ু দূষণ হচ্ছে আশপাশের ইটভাটার কারণে, ১০ শতাংশ বায়ু দূষণ হচ্ছে যানবাহন চলাচলের কারণে, ২০ শতাংশ রাস্তা ও বিল্ডিংসহ বিভিন্ন নির্মাণ কাজের কারণে এবং ১০ শতাংশ অন্যান্য কারণে বায়ু দূষণ হচ্ছে।
এজন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) অনলাইন মনিটরিং করা হবে। ইটভাটা স্থাপনে আশপাশের পরিবেশ নির্ধারণে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এছাড়া নতুন এনভায়রনমেন্টাল পলিসি-২০১৮ শিগগিরই অনুমোদন দেয়া হবে। সেখানে অনেক কিছুই থাকবে।
পরিবেশমন্ত্রী আরও জানান, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পরিবেশ দূষণ রোধে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করার কথা ভাবা হচ্ছে। তাছাড়া সেখানে প্লাস্টিক পণ্যসহ অন্যান্য বর্র্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। শিগগিরই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবেশের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা মরে গেছে। আশপাশের অন্য নদীগুলোরও একই অবস্থা। এসব রক্ষা করতে হবে। এজন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতারও প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর রাজশ্রী এস পারালকার বলেন, বাংলাদেশ উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে যাচ্ছে। টেকসই ও শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে হলে পরিবেশের ওপর নজর দিতে হবে। কেননা দক্ষিণ এশিয়ায় পরিবেশগত কারণে সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। তারপরও আরও বেশি গ্রিন বিনিয়োগ প্রয়োজন।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ক্লিন এয়ার অ্যাক্টের খসড়া তৈরির কাজ চলছে। ভূমি জোনিং ও পানি ব্যবহারসংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। টেকসই বন ব্যবস্থাপনার জন্য সুফল প্রকল্প হাতে নেয়া হচ্ছে। আগামীতে ৬৪টি জেলায় এ রকম জরিপ করা প্রয়োজন।
পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক সুলতান আহমেদ বলেন, এখন থেকে বিভাগীয় ৮টি শহরে নতুন কোনো কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দেয়া নাও হতে পারে। এছাড়া সিইটিপি ও স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।