ফাইজুস সালেহীন : দুয়ারে কড়া নাড়ছে একাদশ সাধারণ নির্বাচন। আশা করা যায় অক্টোবরের শেষে ইলেকশন সিডিউল ঘোষিত হবে। শাসক দল নির্বাচন সামনে রেখে জোর প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের মেঠো বক্তৃতা এবং ওঙ্কার-হুঙ্কারে রাজনীতির মাঠ গরম।
বিএনপি বলছে, বেগম জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবে না। দেশে কোনো নির্বাচন হতেও দেবে না তারা। আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তির আশা তারা একরকম ছেড়েই দিয়েছেন। দলের কোনো কোনো নেতা বলছেন, নেত্রীর মুক্তির আগে কেউ যদি ইলেকশনে যেতে চান, তাহলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে।
তারা রাজপথ কাঁপানো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে বলছেন। অন্যদিকে চলছে সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার দেন-দরবার। এই ঐক্য প্রয়াসের সামনে রয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক খ্যাতিমান আইনবিশারদ ড. কামাল হোসেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা ডা. অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, জাসদের এক সময়ের মাঠ গরম করা নেতা আ. স. ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের মৃদুভাষী মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ।
এই ঐক্য আদৌ কার্যকর শক্তি হবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয়ও রয়েছে। ড. কামাল বারবার বলছেন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত থাকলে তিনি ও তার দল এর মধ্যে নেই। তার মানে দোস্ত-দুশমনের হাতে হাত মিলবে না। পক্ষান্তরে বিএনপির সঙ্গে কাঁঠালের আঠার মতো লেগে আছে জামায়াতে ইসলামী।
নিন্দুকেরা বলতে পারেন, বিএনপি-জামায়াত জোড়া সুপারগ্লু দিয়ে লাগান। এদের আলাদা করা কঠিন। জামায়াতে ইসলামী অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, এক প্রকার নিষিদ্ধই বলা যায়। তা হলেও বিএনপির সভা-সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচিতে জামায়াতের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়।
বুধবার (১২ সেপ্টেম্বর) বেগম জিয়ার মুক্তির দাবিতে বিএনপির প্রতীকী অনশনে সংহতি জানাতে এসেছিলেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া গোলাম পরওয়ার। অনশন সমাবেশে তিনি বলেন, বেগম জিয়ার মুক্তি ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না।
অতীতের মতোই ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে জামায়াত আছে, থাকবে। এমতাবস্থায় জাতীয় ঐক্যপ্রয়াসী নেতারা কী করবেন? বিএনপি হয়তো বলবে, জামায়াত আছে বিশ দলীয় জোটে। বিশ দলের জায়গায় বিশ দল। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য বৃহত্তর ঐক্য হবে বিএনপির সঙ্গে। এরকম একটি গোলক ধাঁধার মিত্রতার বন্ধন রচনা করতে ঐক্যপ্রয়াসী নেতারা কি সম্মত হবেন?
সমস্যা আছে আরও। বি. চৌধুরী আসন বণ্টন ও ভবিষ্যৎ সরকার কাঠামো নিয়ে এখনই চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তিনি বলছেন, বিএনপিকে ১৫০টি আসন ছেড়ে দিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে আসন বণ্টনে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে। কিন্তু একটা ভারসাম্যপূর্ণ পার্লামেন্টের জন্য অন্য দলগুলোকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আসন ছেড়ে দিতে হবে।
আর সরকার কাঠামো কী হবে, কোন মন্ত্রণালয় শরিকদের দেয়া হবে সেটাও এখনই পরিষ্কার হতে হবে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মতো অগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ দেয়া চলবে না। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে। এসব বিষয়ে আগেই চুক্তি হতে হবে।
সম্প্রতি টেলিভিশনে জনাব চৌধুরীর এরকম বক্তব্য শুনে যে কোনো সমালোচক টিপ্পনি কাটতেই পারেন, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল! সাবেক এই রাষ্ট্রপতি হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে, তারা যদি মোর্চা করেন, তাহলে নিরঙ্কুশ মেজরিটি পাবেনই পাবেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বিএনপি প্রস্তাবিত জাতীয় বা বৃহত্তর ঐক্য কেন, কোন পর্যন্ত এবং কী উদ্দেশ্যে, তা এখনও ধোঁয়াচ্ছন্ন। দলটির প্রায়োরিটি কী? আন্দোলন না নির্বাচন? তারা নির্বাচনের আগেই এই সরকারের পতন চায়, নাকি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তাদের ভাষায় অগণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে দিতে চায়।
যদি আন্দোলনের জন্য ঐক্য হয়, তাহলে নিশ্চিত করে কে বলতে পারে, রাজপথের সংগ্রাম সফল হওয়ার পর নতুন পরিস্থিতিতে নতুন মেরুকরণ হবে না। ইলেকশনের পরেও মেরুকরণ হয়। এটা নির্ভর করে ভোটের ফলাফলের ওপর। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক সংখ্যক আসন পেলেও সরকার গঠনের মতো মেজরিটি পায়নি।
জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও জাসদের আ. স. ম আবদুর রবের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেই সরকারের নাম দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। বিদেশেও নির্বাচন-পরবর্তী কোয়ালিশনের আরও অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে।
এখানেও সেটা যদি হয় এবং হওয়া খুবই সম্ভব, তাহলে এখনই আসন বণ্টনের দরকষাকষির কোনো মানে দাঁড়াবে না। মনে রাখা দরকার বিএনপির পরীক্ষিত মিত্র বিশ দল রয়েছে। বিশদলীয় জোট থাকতে নানারকম শর্ত মেনে নতুন মোর্চা করে নির্বাচনে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা শেষমেশ দলটি বোধহয় নাও করতে পারে।
তবে বিএনপির জন্যও এই জায়গাটায় পাতা রয়েছে একটা শাঁখের করাত। আসতেও কাটবে, যেতেও কাটবে। দলটি যদি খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগ ছাড়া নির্বাচনে না আসার সংকল্পে অনড় থাকে আর কার্যকর আন্দোলনও গড়ে তুলতে না পারে, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটাই প্রশ্ন।
সে ক্ষেত্রে বি চৌধুরী, রব, মান্নার যুক্তফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের গণফোরামের ভূমিকাই বা কী হতে পারে। যুক্তফ্রন্টের নেতাদের অতীত এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নয়। সত্তর-একাত্তরের চার ছাত্র খলিফার অন্যতম আ. স. ম আবদুর রব, জাসদের বিপ্লবী নেতা রব, এরশাদের পার্লামেন্টের বিরোধীদলীয় নেতা রব এবং ১৯৯৬ সালের জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের পশুপালন মন্ত্রী আ. স. ম রব আর আজকের যুক্তফ্রন্টের রব- এরা তো একই ব্যক্তি।
জনাব মান্নাও আওয়ামী লীগ ঘুরে আসা এক পোড় খাওয়া নেতা। বিএনপি যদি এই নেতাদের আস্থায় রাখতে না পারে, তাহলে বৃহত্তর ঐক্যপ্রয়াসীরা আলাদাভাবে নির্বাচনে যেতে পারেন বৈকি। সরকারও তখন এই মোর্চাকে সহযোগিতা করবে।
সময়-সময়ান্তরে পোলারাইজেশন এবং ডিপোলারাইজেশন নতুন নয়। রাজা-বাদশার আমলে, রাজনীতি যখন প্রাসাদের ভেতরে সীমাবদ্ধ ছিল তখনও এই খেলা ছিল। রাজনীতিতে পোলারিটির উপাদান সবসময়ই বিদ্যমান। রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাত্রমাত্রই তা জানেন।
বিএনপিকে বাদ দিয়ে অন্য দল ও জোটগুলো নির্বাচনে এলে তারা প্রশাসনের সহৃদয় সহযোগিতা পাবে এই জন্য যে, সরকার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে বিশ্বসমাজকে দেখাতে চাইবে কোথাও কোনো সমস্যা নেই। এরশাদ সাহেবের জাতীয় পার্টি তো আছেই।
দলটি তো আগেই বলে রেখেছে যে বিএনপি ইলেকশনে না এলে জাতীয় পার্টি এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। জাপা, জেপি, যুক্তফ্রন্ট বা নতুন নামের বৃহত্তর ঐক্য ও মোর্চা এবং আওয়ামী লীগ তথা চৌদ্দ দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে আর বাকি থাকবে কী! পুরো পরিস্থিতিটাই তখন চলে যেতে পারে বিএনপির নাগালের বাইরে।
রাজনীতির এই পাটিগণিত বিএনপির নেতারাও জানেন ও বোঝেন। কাজেই যুক্তফ্রন্টকে যে করেই হোক বিএনপি সঙ্গে রাখতে চাইবে। এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক বোদ্ধাদের অনেকেই মনে করেন, বিএনপির আন্দোলনের মূল লক্ষ হতে হবে নির্বাচন। অগ্রাধিকার দিতে হবে নির্বাচনকে। এটা না হলে, সেটা না হলে এদেশে কোনো নির্বাচন হতে দেয়া হবে না- এ ধরনের দেমাকি কথাবার্তার রাশ টেনে ধরা দরকার।
সরকারের পতন হবে, তারপরে নির্বাচন এগুলো কোনো কাজের কথা নয়। মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সূচিত হলে আশা করা যায় আইনি প্রক্রিয়াতেই বেগম জিয়া বেরিয়ে আসতে পারবেন। বেগম জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবীরাই বিভিন্ন সময়ে সে আভাস দিয়েছেন।
সমস্যা নাকি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ। আন্দোলন বেগবান হলে ওই প্রসারিত হস্ত অপনাআপনি সংকুচিত হয়ে আসবে। প্রধানমন্ত্রী বারবারই বলছেন, আমরা দেশের অনেক উন্নতি করেছি। এখন জনগণ যদি আবার ম্যান্ডেট দেন, তাহলে নতুন মেয়াদে সরকারে থাকব, না দিলে নাই।
একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন মেয়াদে নতুন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিক- এটাই তো দেশবাসী চায়। সেই সরকার হোক বিএনপির কিংবা আওয়ামী লীগের, তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। ভালো ইলেকশন হলে ভালো সরকার হবে এতে আর সন্দেহ কী!
ফাইজুস সালেহীন : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
saleheenfa@gmail.com