এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রেলের উন্নয়নে সরকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। ৩০ বছর মেয়াদি এ মহাপরিকল্পনায় (মাস্টার প্ল্যান) ছয় লাখ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে রেলে আমূল পরিবর্তন আসবে। ইলেকট্রিক ও বুলেট ট্রেনসহ দ্রুতগতির ট্রেনে রেলখাতে মহাবিপ্লব ঘটবে। এশিয়া-ইউরোপের সঙ্গে রেলপথে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।
সূত্র জানায়, রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। আর এ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রেলওয়েকে জনবান্ধব ও অত্যাধুনিক পরিবহন হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার পর্যায়ক্রমে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয়কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোম্বর মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে তিনি এ নির্দেশনা দেন। তার দিকনির্দেশনার আলোকে ৩০ বছর মেয়াদি মাস্টার প্ল্যানে (২০১৬-৪৫) ছয়টি পর্যায়ে ২৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে প্রায় ৬ লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকল্পগুলো পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতে ১৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ সময়ের মধ্যে ৭৬টি নতুন প্রকল্প ও ৬৫টি সংশোধিত প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপি প্রকল্পের আওতায় ৪৩টি প্রকল্প চালু করা হয়। এর মধ্যে অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ শেষের পথে। মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০৪৫ সালের মধ্যে রেলওয়েতে আরও ৬০০ ইঞ্জিন, ছয় হাজার যাত্রীবাহী কোচ ও সাত হাজার মালবাহী ওয়াগন কেনা হবে। এছাড়া সবক’টি জেলার সঙ্গে রেল নেটওয়ার্ক স্থাপনসহ দূরত্ব অনুযায়ী ইলেকট্রিক ট্রেন ও বুলেট ট্রেনসহ দ্রুতগামী ট্রেন চালু করা হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত ৩৩০ দশমিক ১৫ কিলোমিটার নতুন রেল লাইন স্থাপন করা হয়েছে। ২৪৮ দশমিক ৫০ কিলোমিটার মিটারগেজ লাইনকে ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর করা হয়েছে। ১১৩৫ দশমিক ২৩ কিলোমিটার রেল লাইন পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ৯১টি নতুন রেল স্টেশন ভবন নির্মাণ এবং ১৭৭টি স্টেশন বিল্ডিং পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ২৯৫টি নতুন রেল সেতু নির্মাণ এবং ৬৪৪টি পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। ৪৬টি লোকোমোটিভ, ২৭০টি যাত্রীবাহী কোচ, ৫৪৬টি মালবাহী ওয়াগন ও দুটি রিলিফ ক্রেন সংগ্রহ করা হয়েছে। ৪৩০টি যাত্রীবাহী কোচ ও ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন করা হয়েছে। ১১৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে। ৩৬টি ট্রেনের সার্ভিস ও রুট বর্ধিত করা হয়েছে। এছাড়া তারাকান্দি-বঙ্গবন্ধু সেতু (পূর্ব) ৩৫ কিলোমিটার ও পাবনা-মাঝগ্রাম ২৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। ৬৫টি রেলওয়ে স্টেশন থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকিট কাটা এবং ফিরতি টিকিট নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ১০২টি বন্ধ রেলওয়ে স্টেশন আবার চালু করা হয়েছে। দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ প্রকল্পের আওতায় ১২৯ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ কাজ চলছে।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুর জেলার ভাঙা এবং যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এছাড়া ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এবং কুমিল্লার লাকসাম হয়ে চট্টগ্রামে রেল লাইন নির্মাণ করা হবে। এ প্রকল্পের ব্যয় ৩১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। ১৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং বিশদ ডিজাইনের কাজ চলছে। যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতুর সমান্তরালে ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাক সংবলিত রেলসেতু নির্মাণে ব্যয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে। রাজধানীর যানজট মুক্ত করতে ঢাকার কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে দুটি অত্যাধুনিক ট্রানজিট হাব নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষার কাজ চলছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আন্ডারগ্রাউন্ড-ওভারপাস দিয়ে অনায়াসে প্রবেশ ও বের হওয়া যাবে। থাকবে আবাসিক হোটেল শপিং মলসহ বিভিন্ন সুবিধা।
রেলপথমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক জানান, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দেশে বুলেট ও ইলেকট্রিক ট্রেনসহ দ্রুতগতিসম্পন্ন ট্রেন চলবে। এজন্য মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরামর্শ ও সহযোগিতায় রেলে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নেয়া প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ রেলও বিশ্বের অনন্য রেলওয়েতে পরিণত হবে। রেলওয়ে মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, রেলওয়ের ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন হচ্ছে। চলমান ও মাস্টার প্ল্যানের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশের রেলও আধুনিক হবে। তবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে পর্যাপ্ত লোকবল খুবই জরুরি। এখনও ১৫ হাজার ৫৫৮টি শূন্যপদ রয়েছে। তিনি বলেন, রেল সেবা খাত। এখানে লাভ কিংবা লোকসান বড় কিছু নয়। যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত করাই হবে রেলওয়ের কাজ।
রেলপথ বিভাগের অর্থনীতিবিদ এসএম সলিমুল্লাহ বাহার জানান, রেলওয়েতে প্রায় ১১ হাজার লোকবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রেলওয়েতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সরকার থেকে প্রতি বছরই চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি ঋণ সহজে পাওয়া যাবে। রেল নেটওয়ার্কের মধ্যে মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান-ইরান হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত সংযুক্ত হবে।