ড. বিএম শহীদুল ইসলাম : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘জাতীয় ঐক্য’ গঠন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে খুব তোড়জোড় চলছে। একদিকে ২০ দলীয় জোট সম্প্রসারণ এবং অন্যদিকে ১৪ দলীয় জোটের কলেবর বৃদ্ধি নিয়ে রাজনৈতিক ময়দান এখন দিন দিন সরগরম হয়ে উঠছে।
বড় দলগুলো ছোট দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে টানার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখেই বড় রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ছোট রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের তৎপরতা নিয়ে নড়েচড়ে আয়োজন করে বসেছে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে যদি দেশের জন্য কিছু করা যায় তাতে মন্দ কী? তাছাড়া একটু দৌড়-ঝাঁপের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক গুরুত্ব যদি কিছুটা হলেও বাড়ে তাতে তো সমস্যা নেই।
এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বি. চৌধুরী, আ স ম রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের সমন্বয়ে একটি ‘যুক্ত ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়েছে।
ড. কামাল হোসেনও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন। আবার বিশেষ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বড় দল বিএনপি অনেক আগে থেকেই জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় ঐক্য গঠন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া বিশদলীয় জোটের বাইরে অন্যান্য ছোট দলের সঙ্গে বিভিন্নভাবে তিনি যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছেন বলে জানা যায়।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও কারাগারে যাওয়ার আগে সমমনা দলগুলোর প্রতি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগেরও তাদের জোটের কলেবর বৃদ্ধির প্রচেষ্টার কিছুটা নমুনা পাওয়া যায়।
এদিকে ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য গঠনের তৎপরতাকে কোনো কোনো রাজনৈতিক নেতা ট্যারা চোখে দেখছেন। তারা কটাক্ষ করে বলছেন, ‘কানা ছেলের নাম কখনও পদ্মলোচন হয় না’।
কেউ কেউ বলছেন, ‘ড. কামাল হোসেন তো জীবনেও নির্বাচিত হতে পারেননি, তার আবার ঐক্য গঠন’ ইত্যাদি। তবে ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রক্রিয়ায় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন, তাতে এক পর্যায়ে তিনি হয়তো সফল হবেন।
কিন্তু কথায় বলে, ‘লেবু যত কচলানো হয় ততই তিতা হয়’। ড. কামাল হোসেন একজন সংবিধানপ্রণেতা। বাংলাদেশের সংবিধান নিয়ে তিনি কাজ করেছিলেন।
তাই তার নাম আজও ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। তাছাড়া তিনি একজন বড় মাপের আইনজ্ঞ। তাই তার আহ্বানে সব রাজনৈতিক দল সাড়া দেবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু যেসব শর্তে তিনি জাতীয় ঐক্যের কাজ করছেন তা মঙ্গলজনক হবে বলে মনে হচ্ছে না। শর্তের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তা যদি না হয়, তাহলে তাদের জাতীয় ঐক্য গঠন প্রক্রিয়ার খুব একটা গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। কারণ ড. কামাল হোসেনের পহেলা শর্ত হচ্ছে- ২০ দলীয় জোট থেকে আগে জামায়াতকে বাদ দিতে হবে। তার অর্থ দাঁড়ায় আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে ফেলতে হবে।
আর যখন ২০ দলীয় জোট ভেঙে যাবে তখন বিএনপিও নতুন করে সংকটে পতিত হবে। এ সুযোগে ওইসব ছোট ছোট দলের রজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাবে এবং তারা নির্বাচনী দরকষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারবে।
কারণ হিসেবে বলা যায়, ২০ দলীয় জোটের মধ্যে বিএনপির বড় সহযোগী শক্তি হচ্ছে জামায়াত। তাই জামায়াতকে বাদ দিয়ে যাদের সঙ্গেই বিএনপি জাতীয় ঐক্যে যাক না কেন ভোটের হিসাবে তাদের পক্ষ থেকে কতটুকু সমর্থন লাভ করতে পারবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। তাই ড. কামাল হোসেনের দেয়া শর্ত হালে পানি পাবে বলে মনে হয় না।
প্রথম শর্ত অনুযায়ী জামায়াতকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠিত হলে যা ঘটবে-
১. জামায়াতকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠিত হলে ২০ দলের বড় একটি অংশ কমে যাবে। ভোটের ময়দানেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাতে করে বিএনপি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে।
কারণ বিএনপির দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু হচ্ছে জামায়াত। মিছিল-মিটিং, মাঠে-ময়দানে আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির চোখে পড়ার মতো ভূমিকা রেখেছে সব সময়।
এমনকি বিএনপি এত বড় দল হওয়া সত্ত্বেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামায়াতের মতো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
যদি জামায়াত ছাড়া বিএনপি জাতীয় ঐক্য করতে রাজি হয়, তাহলে তাদের অবস্থা হবে খাল কেটে কুমির আনার মতো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা দেশে জামায়াতের যে ভোট ব্যাংক আছে, তা থেকে বিএনপি বঞ্চিত হলে জাতীয় ঐক্য করে তাদের কোনো লাভ হবে না। আর যেসব দল জাতীয় ঐক্যের জন্য বিএনপিকে জামায়াত বাদের শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তাদের মধ্যে কোনো কোনো দল একটি আসনেও বিজয়ী হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাই জাতীয় ঐক্য করতে হলে জামায়াতকে ২০ দলে রেখে করলে সব দল ঐক্যের সুফল ভোগ করতে পারবে এবং উপকৃত হবে।
২. যারা জামায়াত বাদের শর্ত দিচ্ছে, তাদের একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য আছে বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন। তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০ দলীয় জোটে জামায়াত দ্বিতীয় বৃহত্তম দল এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জনশক্তির দিক বিবেচনায় তৃতীয় বা চতুর্থ শক্তি।
সারা দেশে জামায়াতের প্রচুর জনশক্তি রয়েছে। এমন অনেক আসন আছে যেখানে পৃথকভাবে নির্বাচন করলে জামায়াতের প্রার্থী জিতে আসতে পারবে।
তাছাড়া জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল দলও বটে। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহানের মতে, ‘জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল দল এবং তারা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের দল পরিচালনা করে থাকে- যা অন্য কোনো দল করে না। গণতন্ত্রের অনুশীলন কেবল জামায়াতের মধ্যেই বেশি’।
জামায়াত বাদের শর্ত আরোপকারীদের লক্ষ্য হচ্ছে- জামায়াত না থাকলে জাতীয় ঐক্যে প্রভাব খাটানো যাবে। বিএনপির পরেই তাদের অবস্থান হবে। ফলে তারা যা চাইবে তাই পাওয়া যাবে বলে তারা মনে করেন। মন্ত্রিত্ব থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সব দাবিই করা যাবে।
কিন্তু জামায়াত থাকলে হয়তো সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের আবদার হচ্ছে- জামায়াতকে ২০ দল থেকে বাদ দিতে হবে, তাহলেই কেবল জাতীয় ঐক্য হতে পারে।
৩. ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে যারা জাতীয় ঐক্য করতে চায়, তাদের আসল পরিচয় সবাই জানে। সবার জেনে রাখা উচিত, পানির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সব সময় নিজের সুবিধামতো ঢালুর দিকে গড়িয়ে যাওয়া।
যারা বিএনপির সঙ্গে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য করতে আগ্রহী ওইসব দলের একটি দল ছাড়া বাকিদের উৎস সম্পর্কে সবার জানা আছে।
ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দকী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না সবাই একসময় বিশাল একটি সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সেখান থেকে তারা ভিন্ন ভিন্ন খালে নিজেদের আবিষ্কার করেছেন। যে খালের কখনও অন্য একটি মহাসমুদ্রের সঙ্গে মিশতে পারা কঠিন।
কারণ মহাসমুদ্র ছাপিয়ে খালগুলোর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা বলা মুশকিল। তাই তারা জামায়াতকে বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ার স্বপ্নে বিভোর বলে অনেকেই মনে করছেন।
৪. ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি বি. চৌধুরী বিএনপি থেকে সিটকে পড়া একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনিও একটি নতুন খালের মালিক।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তাকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য হলে নির্বাচনের কিছুদিন আগে তিনি যদি ডিগবাজি খেয়ে অন্য জোটের সঙ্গে মিলে বিপরীতমুখে ধাবিত হন তখন কী হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা দেয়া যায় না।
এমন পরিস্থিতি ঘটলে ২০ দলীয় জোটকে আরও একদফা ট্র্যাপে পড়তে হতে পারে। তখন তাদের দীর্ঘদিনের সব অর্জন বিনষ্ট হওয়া ছাড়া বিকল্প কিছু থাকবে না।
সুতরাং সত্যিকার অর্থে যদি কেউ গণতন্ত্র ও দেশের স্বাধীনতার সুরক্ষা ও উন্নয়নের স্বার্থে জনগণের কল্যাণে জতীয় ঐক্য গঠন করতে চান, তাহলে সবাইকে কিছু না কিছু ছাড় দিতে হবে।
ড. বিএম শহীদুল ইসলাম : প্রবাসী রাজনৈতিক বিশ্লেষক