এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বেসরকারি ফ্লাইট অপারেটর কোম্পানি ইউএস-বাংলার একটি বিমান বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে। বিমানটি বুধবার দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কক্সবাজার যাচ্ছিল।
কক্সবাজার বিমানবন্দরে অবতরণের সময় সামনের চাকা না খোলায় বিমানটি (বোয়িং ৭৩৭) চট্টগ্রামে যায় এবং দুপুর সোয়া ১টায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করে। এ সময় পাইলটের দক্ষতায় ফ্লাইটটি ‘বেলি পদ্ধতিতে’ রানওয়েতে একপ্রকার মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে বিমানটিতে থাকা ১১ শিশু ও ৭ ক্রুসহ ১৭১ জন যাত্রী অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন। যদিও নামার সময় আহত হয়েছেন কয়েকজন যাত্রী।
চট্টগ্রামের শাহ আমানতে জরুরি অবতরণের আগে প্রায় আধা ঘণ্টা আকাশে চক্কর কাটে বিমানটি। এ সময় যাত্রীদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচায় স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করেন তারা। কয়েকজন যাত্রী বলেন, যেন নতুন জীবনের স্বাদ পেয়েছি।
এদিকে দুপুরে এ ঘটনার পর থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমান উঠানামা বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে ফ্লাইটটি ক্রেন দিয়ে টেনে রানওয়ে থেকে সরানোর পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফের বিমান উঠানামা শুরু হয়। দুর্ঘটনার কারণে বেশ কয়েকটি ফ্লাইট ছাড়তে দেরি হয়। এছাড়া এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ।
বিমানের জরুরি অবতরণের বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ জানায়, সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী ইউএস-বাংলার বিএস-১৪১ ফ্লাইটটি কক্সবাজার বিমানবন্দরে পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তে পাইলট টেকনিক্যাল কারণে জরুরি অবতরণের প্রয়োজন অনুভব করেন। কিন্তু কক্সবাজারে পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায় চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। পরে ফ্লাইটটি সেখানে অবতরণ করে এবং সব যাত্রী, ক্রু ও পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসেন। যাত্রী ও বিমানের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এ প্রসঙ্গে ইউএস-বাংলার জনসংযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ৪ বছরে আমরা ৪৫ হাজার ফ্লাইট অপারেট করেছি। যাত্রীদের নিরাপত্তাই আমাদের কাছে সর্বাগ্রে বিবেচ্য। তা ছাড়া নেপালে একটি ফ্লাইট দুর্ঘটনায় ৫১ জন নিহত হওয়ার পর আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করছি। এরপরও এ ধরনের টেকনিক্যাল ত্র“টি শুধু ইউএস-বাংলায় নয়, যে কোনো ফ্লাইটের ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক। তবে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করায় এবং যাত্রীরা রক্ষা পাওয়ায় আমরা স্রষ্টার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। যাত্রীরা সহযোগিতা করায় তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানাই আমরা।
এ বিষয়ে শাহ আমানত বিমানবন্দরের সিনিয়র এয়ার ট্রাফিক অফিসার হাসান জহির বিকালে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইউএস-বাংলার ফ্লাইটটি উড্ডয়ন করে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কক্সবাজার বিমানবন্দরে নামার সময় ফ্লাইটটির সামনের একটি চাকা খুলছিল না। এ অবস্থায় কয়েকবার আকাশে চক্কর দেয়ার পরও স্বাভাবিক অবতরণে ব্যর্থ হয়ে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পাইলট।
শাহ আমানতে জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত পেয়ে পাইলট চাকার ত্র“টি নিয়েই ‘বেলি পদ্ধতিতে’ অর্থাৎ চাকা নামানোর পরিবর্তে বিমানের ‘পেট’ রানওয়েতে ধীরে ধীরে ছুঁইয়ে দেন। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সব যাত্রী ও ক্রু সুস্থ আছেন। ইমারজেন্সি এক্সিট ব্যবহার করে তাদের নিরাপদে নামিয়ে আনা হয়।
ফ্লাইটটির পাইলট ক্যাপ্টেন জাকারিয়া জরুরি অবতরণ সম্পর্কে বলেন, চাকায় ত্রুটি ধরা পড়ার পর যাত্রীদের প্রাণ বাঁচানোই ছিল আমার লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত বিকল্প পদ্ধতিতে ফ্লাইটটি অবতরণ করাতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরের ম্যানেজার উইং কমান্ডার সারোয়ার-ই-জাহান বলেন, ফ্লাইটটি কক্সবাজারে অবতরণের সময় পাইলট লক্ষ্য করেন সামনের চাকা নামছিল না। এ কারণে কক্সবাজারে অবতরণ করতে না পেরে চট্টগ্রামে আসে ফ্লাইটি। সামনের চাকা না নামিয়েই অর্থাৎ ‘নোজ গিয়ার’ ছাড়াই নিরাপদে অবতরণ করে। আরোহীরা সবাই নিরাপদে আছেন। তিনি বলেন, ফ্লাইটটি রানওয়েতে পড়ে থাকায় কোনো ফ্লাইট উঠানামা করতে পারেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায় ফ্লাইটটি সরানোর পর পুনরায় বিমান উঠানামা শুরু হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দীন বলেন, ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৬টি গাড়ি শাহ আমানতে অবস্থান নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি।
বিমানে থাকা ইসমাইল ফারুক মানিক নামের এক যাত্রী শাহ আমানত বিমানবন্দরে বলেন, বিমানটি অবতরনের আগে প্রায় আধা ঘণ্টা আকাশে চক্কর দেয়। এ সময় যাত্রীরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। পাইলট ঘোষণা দেন টেকনিক্যাল ত্রুটির কারণে কক্সবাজারে অবতরণ করানো যাচ্ছে না, তারা চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন। বিষয়টি যাত্রীদের বুঝতে দেয়া না হলেও সবার মধ্যে আতঙ্ক শুরু হয়।
দুপুর সোয়া ১টার দিকে শাহ আমানতে ফ্লাইটটি অবতরণের আগ মুহূর্তে পাইলট ঘোষণা দেন ‘আপনারা শরীর হালকা করে ফেলেন। শরীরে ভারি কিছু রাখবেন না’। সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে নামে বিমানটি। যাত্রীরা একজন আরেকজনের ওপর গিয়ে পড়েন।
নাসির উদ্দিন নামের অপর এক যাত্রী জানান, তিনি সৌদি আরব থেকে এসেছেন। ওই ফ্লাইটে তিনি কক্সবাজারে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, এটি অনেক বড় দুর্ঘটনা। আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল বলে আমরা বেঁচে গিয়েছি।
শায়লা নাজনীন নামের এক যাত্রী বলেন, দুর্ঘটনার বিষয়ে আমাদের অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। অস্বাভাবিক অবতরণের পর হুড়োহুড়ি করে নামতে গিয়ে অনেকেই আহত হয়েছেন। কারও কারও হাত-পা কেটে গেছে। আমার বড় বোনও আহত হয়েছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে দুর্ঘটনা কবলিত বিমানটি ক্রেন দিয়ে রানওয়ে থেকে সরানো হয়। এ দুর্ঘটনার কারণে শাহ আমানত বিমানবন্দরে কলকাতা থেকে আসা চারটি ফ্লাইট ডিলে হয়েছে।