এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বাংলাদেশে প্রতি বছরই তাপমাত্রা ও অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। এগুলো মোকাবেলায় ব্যবস্থা না নিলে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বেন। জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে যাবে।
জিডিপির (দেশজ উৎপাদন) ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষতি হবে। ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ‘বাংলাদেশ চাপ্টারে’ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বুধবার রাজধানীর একটি হোটেলে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করতে প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের বাইরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অধিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশ স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়ার আশা করে। কিন্তু বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে চলে যাওয়ায় দাতা সংস্থার কাছ থেকে স্বল্প সুদে ঋণ পাওয়া কঠিন হচ্ছে। ইতিমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে। অবকাঠামোসহ বিভিন্ন খাতে আমরা বিনিয়োগ আশা করছি।
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট হাডিন শেফার বলেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন। কক্সবাজার পরিদর্শনে দেখেছি ওই অঞ্চল ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এতে জীবনযাত্রার মান কমে যাবে এবং দারিদ্র্যের হার বাড়বে। এজন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর চিমিয়াও ফ্যান বলেন, আগামীতে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমে যাবে। আর জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া অবকাঠামো খাতও ক্ষতি হবে।
তিনি বলেন, প্রতিবেদনে নানা বিষয় শনাক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে শনাক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা সক্রিয় হবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। চিমিয়াও আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের একটি বড় অংশ মাইগ্রেশন হতে পারে।
এছাড়া প্রতি বছরই দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে। এজন্য জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাকে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন, জলবায়ুর প্রভাব মোকাবেলায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থায়নের জন্য প্রয়োজন হবে। দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি সরবরাহসহ অন্য সব খাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার। জলবায়ু মোকাবেলায় বাংলাদেশকে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলো দু’ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। একটি হল- জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেয়া। এতে কোন এলাকাগুলো ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যবস্থা নেয়া না হলে কোন এলাকাগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে তা দেখানো হয়েছে।
২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক প্রভাব কতটা পড়বে তাও প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। কোন অঞ্চল কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে তা নিয়েই মূলত বিশ্বব্যাংক সমীক্ষা চালিয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অস্বাভাবিক তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের কারণে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে দক্ষিণ এশিয়া। এ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি লোক ঝুঁকিতে আছেন। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ প্রত্যাশা করছে বছরে গড় হারে তাপমাত্রা বাড়বে ১ থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এর মোকাবেলা বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে কোনো পদক্ষেপ না নিলে বছরে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের চার-তৃতীয়াংশ মানুষের জীবনযাত্রার মান নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়- ১০টি ঝুঁকিপূর্ণ জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান সবচেয়ে বেশি নিচে নেমে যাবে। পাশাপাশি কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মান ১৮ শতাংশের নিচে নেবে যাবে। কারণ সংঘাতের মুখে মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আগমনে জেলার জীববৈচিত্র্য ঝুঁকির মধ্যে আছে।
চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড়ি এলাকা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। এ অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। বনের পরিমাণও কমে আসবে। এর ফলে ভূমি ধসের কারণে সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। চট্টগ্রাম রাঙ্গামাটি ও নোয়াখালী জেলায়ও একই অবস্থা হতে পারে।
প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু পরিবর্তনে সম্ভাব্য ক্ষতির প্রভাব মোকাবেলায় কৃষি খাতের বাইরে ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টির তাগিদ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, কৃষি খাতের বাইরে ৩০ শতাংশ কর্মসংস্থান করলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীবনযাত্রার মান না কমে উল্টো বাড়বে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন হিমবাহ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বাড়ছে। এ কারণে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে তুলনামূলক নিুভূমি বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। একই কারণে ভারতীয় মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় ও তৎসংলগ্ন স্থল ভূমিতে বন্যার প্রাদুর্ভাব বাড়বে বলেও আশঙ্কা করা হয়েছে। এতে ঢাকা, করাচি, মুম্বাই ও কলকাতার মতো নগরগুলোতে ৫ কোটি বাড়তি লোকের চাপ পড়বে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ভোগের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে ভোগের চাহিদা ১১ শতাংশ, নেপালের ১৩ শতাংশ ও শ্রীলঙ্কায় ১২ শতাংশ কমবে।