এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের বেতন বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকদের বেতন ১৪০ শতাংশ এবং সহকারী শিক্ষকদের বেতন ১১৭ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নীতিমালা’ অনুমোদনের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ে বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ সূত্র জানায়, নীতিমালাটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। ২০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর মঙ্গলবার তা ফেরত আসে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ৩ হাজার ৪৩৩টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে, যেগুলোয় শিক্ষক রয়েছেন ১৫ হাজার ২৪৩ জন এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ লক্ষাধিক। ২০১০ সালের শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষার অন্যান্য ধারার সঙ্গে সমন্বয় রেখে ইবতেদায়ি পর্যায়েও বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ স্টাডিজ, আইসিটির মতো বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলায় ধর্মীয় শিক্ষার বিষয়গুলো পড়ানো হয়।
দেশে দু’ধরনের ইবতেদায়ি মাদ্রাসা আছে। একটি দাখিল বা এর উচ্চতর মাদ্রাসার সঙ্গে সংযুক্ত, আরেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতো স্বতন্ত্র। বর্তমানে এমপিওভুক্ত সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষকরা মাসে ১০ হাজার ৩৮৮ টাকা এবং সহকারী শিক্ষকরা মাসে ৯ হাজার ৯৮৮ টাকা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ১৫ হাজার ২৪৩ শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ৫২৯ জন সরকারি অনুদান পাচ্ছেন। এর মধ্যে প্রধান শিক্ষকরা ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং জুনিয়র শিক্ষক ও কারীরা ২ হাজার ৩০০ টাকা করে পাচ্ছেন। অবশ্য বর্তমান মহাজোট সরকারের শুরুতে এসব শিক্ষক ৫০০ টাকা অনুদান পেতেন। নতুন প্রস্তাবে প্রধান শিক্ষকরা বেতন পাবেন ৬ হাজার এবং জুনিয়র শিক্ষক ও কারীরা পাবেন ৫ হাজার টাকা করে।
তবে এরপরও এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (মাদ্রাসা) রওনক মাহমুদের নেতৃত্বে একটি কমিটি খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরপর বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে নীতিমালাটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর বলেন, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে জনগোষ্ঠীর সর্বাধিক মঙ্গলসাধন। স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসায় অনেক ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে। তাদের শিক্ষাজীবন নির্বিঘ্ন রাখতে শিক্ষকদের আর্থিক দিক উন্নত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি যেনতেনভাবে যেন আর কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠে, সেজন্য একটি নীতিমালা দরকার। এসব বিবেচনায় সরকার নীতিমালা তৈরিসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
কী আছে নীতিমালায় : নীতিমালা অনুযায়ী মাদ্রাসা স্থাপনের অনুমোদন দেবে মাদ্রাসা বোর্ড। তবে তার আগে বোর্ডকে সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। ব্যক্তির নামে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত কোনো ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা যাবে না।
প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে চাইলে আগে মাদ্রাসার নামে জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে। এরপর সেই জমির দলিলসহ আবেদন করতে হবে। বছরের প্রথম ৩ মাস শুধু আবেদন নেয়া হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের নামে স্থায়ী আমানত হিসেবে ব্যাংকে ২০ হাজার টাকা থাকার প্রমাণপত্র দিতে হবে। প্রস্তাবিত মাদ্রাসা মফস্বল এলাকায় হলে তার নামে শূন্য দশমিক ৩৩ একর জমি, শহর বা পৌর এলাকায় হলে তার নামে শূন্য দশমিক ২০ একর ও মহানগর এলাকায় হলে শূন্য দশমিক ১০ একর জমি থাকতে হবে। রেজিস্ট্রি করা জমির নামজারি ও ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের হালনাগাদ দাখিলাও থাকতে হবে।
নতুন স্থাপনের ক্ষেত্রে দুই মাদ্রাসার মধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব থাকতে হবে- মহানগর এলাকায় এক কিলোমিটার, শহর বা পৌর এলাকায় দেড় কিলোমিটার এবং মফস্বল এলাকায় দুই কিলোমিটার দূরত্ব থাকতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বা জাতীয় শিক্ষাক্রম এবং পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অনুমোদিত সিলেবাস বা পাঠ্যপুস্তক পাঠদান করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা মেনে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করতে হবে। পাশাপাশি সহশিক্ষাক্রম পরিচালনা করতে হবে। মহানগর, পৌর ও শহর এলাকার মাদ্রাসায় কমপক্ষে ২০০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এর মধ্যে প্রতি শ্রেণীতে কমপক্ষে ২০ জন থাকতে হবে। মফস্বল এলাকার মাদ্রাসায় ন্যূনতম ১৫০ শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এর মধ্যে ক্লাসপ্রতি ১৫ জন থাকতে হবে। তবে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এলাকার জন্য এ শর্ত শিথিলযোগ্য। সমাপনী পরীক্ষায় মহানগর/পৌর/শহর এলাকার প্রতিষ্ঠান থেকে ন্যূনতম ২০ শিক্ষার্থী অংশ নিতে হবে। তাদের মধ্যে ১৫ জন পাস করতে হবে। গ্রাম এলাকায় সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে ১৫ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন পাস করতে হবে।
মাদ্রাসা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেক উপজেলা বা থানায় পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি থাকবে, যার সভাপতি হবেন ইউএনও। তবে মহানগর এলাকায় হবেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্য সচিব হবেন উপজেলা বা থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। সদস্যরা হবেন উপজেলা বা থানা সদরের এমপিওভুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রধান, স্থানীয় শিক্ষানুরাগী। এর মধ্যে দু’জন মনোনয়ন দেবেন কমিটির সভাপতি। স্থানীয় সংসদ সদস্য নিজের প্রতিনিধিরূপে একজন নিয়োগ দেবেন। এ কমিটির অনুমোদিত কমিটি মাদ্রাসা পরিচালনা করবে। মাদ্রাসা কমিটির নাম হবে ব্যবস্থাপনা বা সাংগঠনিক কমিটি, যার সদস্য থাকবেন ৭ জন। সুনির্দিষ্ট গুরুতর অপরাধের দায়ে মাদ্রাসা কমিটি ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা উপজেলা/থানা শিক্ষা কমিটির থাকবে।
নীতিমালায় বলা হয়, প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেবেন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। তবে অন্য শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেবেন প্রধান শিক্ষক। উভয় ক্ষেত্রে নিয়োগের তালিকা নির্বাচন করবে নিয়োগ কমিটি, যা হবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বা মহানগরে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নেতৃত্বে।
নীতিমালায় মাদ্রাসা ভবনের ব্যাপারে ৮টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, ন্যূনপক্ষে টিনের বেড়াসহ টিনশেড ঘর থাকতে হবে। শিক্ষকের বসার জন্য একটি কক্ষ এবং পাঁচটি শ্রেণীকক্ষ থাকতে হবে। শ্রেণীকক্ষ হবে মফস্বলে দেড় হাজার এবং মহানগর/পৌর/শহর এলাকায় দুই হাজার বর্গফুটের। শিক্ষকের কক্ষ হবে দেড়শ’ বর্গফুটের। পর্যাপ্ত আসবাবপত্র, মানসম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে পর্যায়ক্রমে নিতে হবে। খেলার মাঠ ও পাঠাগার থাকতে হবে।