এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : এটা চিন্তা করা কঠিন কিভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ আগামী নির্বাচনে হারবেন। প্রধান বিরোধী দলগুলো বিশৃঙ্খল অবস্থায়। এই অবস্থার আংশিক কারণ হলো তাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকারের বিরামহীন মামলা। তারপরও নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর নিপীড়ন আরো নৃশংস হয়ে উঠছে। লন্ডনের প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক নিবন্ধে এসব বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, সমালোচকদের ওপর সর্বশেষ আক্রমণের নজির হলো অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের একটি বিল, যেটি সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে পার্লামেন্ট অনুমোদন করে। এই আইনের নিপীড়নমূলক বিধানের মধ্যে রয়েছে: ১৯৭১ সালের যেই যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল সেই যুদ্ধ নিয়ে কেউ ‘অপপ্রচার’ চালালে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড। শেখ হাসিনার পিতা এই স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আরেকটি অস্পষ্ট ধারায় ‘আক্রমণাত্মক ও ভীতিকর’ বিষয়বস্তু পোস্ট করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলছেন, চরমপন্থা ও পর্নোগ্রাফির প্রচার বন্ধে এই আইন প্রয়োজনীয়। তবে, সাংবাদিকরা আতঙ্কিত।
তবে, এই বিলই সরকারের একমাত্র অস্ত্র নয়। বিরূপ নিবন্ধ প্রকাশ করেন যেসব সংবাদপত্রের সম্পাদক তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও মানহানির অসংখ্য অভিযোগ আনা হয়েছে। একজনের বিরুদ্ধে একপর্যায়ে ৮০টি মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানী ঢাকায় অনিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে কথা বলার পর আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে আগস্টে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ‘মিথ্যা তথ্য প্রচারে’র অভিযোগে। এই আন্দোলন যেভাবে সরকার মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্টের ব্যাপারে ফেসবুকের কাছেও অভিযোগ দিয়েছে।
এ ছাড়াও আছে স্বাধীনচেতা বিচারকদের ওপর আক্রমণ। ২০১৪ সালে পার্লামেন্ট একটি সংবিধান সংশোধনী পাস করে। এর ফলে সরকারের জন্য আরো সহজে বিচারকদের বরখাস্ত করার সুযোগ তৈরি হয়। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট ওই সংশোধনী বাতিল করে। তখনই সরকার আকস্মিকভাবে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে। তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায়ই পদত্যাগ করেন। সেপ্টেম্বরে তিনি একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, প্রধানমন্ত্রীর দল আওয়ামী লীগ বিচারকদের প্রায়শই ভয়ভীতি দেখায়।
পুলিশও গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কম। এই বছরের শুরুর দিকে মাদকবিরোধী অভিযানে প্রায় ২০০ জনের প্রানহানি হয়েছে। সরকারের মতে, নিহতদের সবাই গ্রেপ্তার এড়াতে বা ক্রসফায়ারে পড়ে মারা গেছে। কিন্তু নিহত একজনের পরিবারের প্রকাশ করা রেকর্ডিং-এ শোনা যায়, ওই ব্যক্তিকে পুলিশের আতঙ্কজাগানিয়া বিশেষ অভিজাত স্কোয়াড র্যাবের হেফাজতে হাত বাঁধা ও নিরস্ত্র অবস্থায় গুলি করা হয়েছে। বিরোধী দল দাবি করছে, এই মাদকবিরোধী অভিযানকে ব্যবহার করে সরকার প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের সরিয়ে দিচ্ছে। তবে, এই অভিযোগ সরকার অস্বীকার করে।
কিন্তু হতাহতরা সবাই যদি মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত হতও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মিনাক্ষী গঙ্গোপ্যাধ্যায়ের মতে, ‘তারা দোষী না কি অপরাধী তা বিচার করার দায়িত্ব পুলিশ বা সরকারের নয়।’
একসময় আওয়ামী লীগ আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালাবদল হতো। সংবিধানে একসময় বিধান ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন পরিচালনা করবে যাতে সুষ্ঠুতা নিশ্চিত হয়। কিন্তু একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ম্যান্ডেট অতিক্রম করে মেয়াদ বৃদ্ধি করায়, শেখ হাসিনা বিএনপির আপত্তি উপেক্ষা করে সংবিধান সংশোধন করে পুরো ব্যবস্থাই বাতিল করেন।
বিএনপি পরবর্তী নির্বাচন (২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত) বয়কট করে। ফলে দলটির এখন পার্লামেন্টে কোনো আসন নেই। এই বছরের শুরুর দিকে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়। যখন খালেদা ও হাসিনা পালাবদল করে প্রধানমন্ত্রী হতেন, দু’জনকে বলা হতো দুই বেগম। খালেদার ছেলেও দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত। তিনি বৃটেনে নির্বাসিত থেকে দল পরিচালনা করছেন। বিএনপির মিত্র একটি ইসলামিস্ট দলের কয়েকজন নেতাকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সংঘটিত অপরাধের দায়ে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। ওই দলটি পাকিস্তানের বিভক্তির বিরোধিতা করেছিল। দলটির অন্য নেতারা কারাগারে। দুই দলের কোনোটিই দৃশ্যত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে সমর্থ নয়, যদি তারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে সম্মত হয়ও।
বেশিরভাগ পর্যবেক্ষক মনে করেন, শেখ হাসিনা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চান। ফলে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া কার্যত একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়াটা নিশ্চিত হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে সরকারের ওপর জনক্ষোভ মিইয়ে যাবে। বরং, এটি ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে। জামায়াতে ইসলামিকে দুর্বল করার কারণে বেশ কয়েকটি নতুন ইসলামি সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। এদের অনেকগুলোই চরমপন্থি।
বিদেশি, সমকামী ও সরব ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের ওপর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নৃশংস সন্ত্রাসী হামলার পর সরকার সহিংস ইসলামি গোষ্ঠীগুলোকে দমন করেছে। এরপর থেকে রক্তারক্তি কমেছে। কিন্তু এ থেকে উৎসারিত চরমপন্থি প্রবণতা কমেনি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রাক্তন এক কর্মকর্তার মতে, ‘যদি আদৌ কিছু হয়ে থাকে, এটি বরং বাড়ছে।’