এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সমঝোতার পথ খোলা রেখে চূড়ান্ত আন্দোলনের ছক কষছে বিএনপি। তসফিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সমঝোতার জন্য অপেক্ষা করবেন নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে সরকার সাত দফা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নিলে রাজপথই বেছে নেবেন তারা। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করলে ওই দিন থেকেই আন্দোলন শুরু হবে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে শুরু হবে চূড়ান্ত আন্দোলন। এ লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিতে তৃণমূলে বার্তা পাঠানো হচ্ছে। এসবের আগে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হবে। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ দখলে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
দলের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সমঝোতার আগেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে তা বাতিলের দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও এবং সাত দফা আদায়ে হরতালসহ লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সারা দেশ থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হবে। এসব দিক মাথায় রেখে খুব শিগগির আন্দোলনের রোডম্যাপ চূড়ান্ত হবে।
অল্পদিনের আন্দোলনে কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, সেদিকেই বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নেতাকার্মী ছাড়াও অন্য পেশাজীবীদের মতামত নেয়া হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীসহ প্রায় সবাই একই ধরনের মত দিচ্ছেন। আন্দোলনে নামার আগেই কথিত সংস্কারপন্থী এবং নানা সময়ে বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দলে ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা আছে। সংস্কারপন্থীদের মধ্যে যারা অতীতের ভুল স্বীকার করে দলের চেয়ারপারসনের কাছে আবেদন করেছেন শুধু তাদেরই দলে নেয়া হচ্ছে। বহিষ্কৃতদের মধ্যে সাবেক ছাত্রনেতা সানাউল হক নীরু, পাবনা পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু ও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সাবেক সভাপতি এমএ হান্নানসহ অর্ধশতাধিক নেতা রয়েছেন।
তফসিল ঘোষণার আগেই খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাত দফা দাবিতে বিএনপির দু’দিনের কর্মসূচি শেষ হয়েছে। শিগগির নতুন কর্মসূচি দিতে যাচ্ছে দলটি। দাবি আদায়ে বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ জেলায় সমাবেশ করা হবে। এভাবে তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকবেন নেতাকর্মীরা।
এসব কর্মসূচিতে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর নেতাদের সম্পৃক্ত করা যায় কিনা, সেই বিষয়টিও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, তফসিলের আগে সরকারের পদত্যাগসহ সাত দফা দাবি ও ১২ লক্ষ্য ঘোষণা নিয়ে জনমত গঠনের কাজ চলছে। ইতিমধ্যে দাবি ও লক্ষ্য সংবলিত প্রাথমিকভাবে ৩০ লাখ লিফলেট কেন্দ্র থেকে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা শাখায় পাঠানো হয়েছে।
পাশাপাশি জেলা শাখার নেতারা নিজেদের উদ্যোগেও লিফলেট তৈরি করে বিতরণ করছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার আগে দলের ঐক্যের দিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কথিত সংস্কারপন্থী এবং নানা সময়ে বহিষ্কৃত নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দলের ঐক্যের পাশাপাশি সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনে পেশাজীবীসহ সবার সমর্থন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।
জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা সাত দফা দাবি জানিয়েছি। আশা করছি, সরকার আমাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেবে। কিন্তু সরকার যদি একগুঁয়েমি করে আবারও একতরফা একটি নির্বাচন করতে চায়, তাহলে জনগণ তা প্রতিহত করবে।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে কোন ইস্যুতে সেই আন্দোলন হচ্ছে। ইস্যুটা যদি জনসম্পৃক্ত হয় এবং জনগণকে যদি ঐক্যবদ্ধ করা যায়, তাহলে যে কোনো আন্দোলনই সফল হয়। আমরা যে দাবি জানিয়েছি, সেগুলো জনগণের দাবি। সেই দাবি আদায়ে এবার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হবে বলে আশা করছি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত সরকার তাদের সাত দফা দাবি মেনে নেবে বলে মনে হচ্ছে না। বিএনপিকে বাদ দিয়ে তারা আবারও একটি একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা করবে। দাবি আদায় না করে নির্বাচনে গেলে সরকার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে যেনতেন একটি নির্বাচন করবে। দাবি আদায়ের আন্দোলনে অনড় থাকলে সরকার চাপে পড়বে। দেশি-বিদেশিরাও তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ পাবে। ফলে ২০১৪ সালের মতো যেনতেন একটি নির্বাচন সম্পন্ন করে ফের ক্ষমতায় যাওয়া সরকারের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
জানা গেছে, দলকে চাঙ্গা ও আন্দোলনের করণীয় চূড়ান্তে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ছাড়াও পেশাজীবীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন দলের হাইকমান্ড। আন্দোলন ও নির্বাচন নিয়ে তাদের মতামত নিচ্ছেন। দাবি আদায়ে সরকারকে আলটিমেটাম দেয়ার পাশাপাশি আন্দোলনের পক্ষে মত দেন তারা। ৩০ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির জনসভায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারবিরোধী আন্দোলনের বার্তা দেন।
তিনি বলেন, আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাব। দাবি না মানলে পর্যায়ক্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়াকে মুক্ত, তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনা এবং আটক নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে সরকারকে বাধ্য করা হবে।
শুক্রবার এক আলোচনা সভায় দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদও দাবি আদায়ে আন্দোলনের কথাই বলেন। তিনি বলেন, আমাদের দাবির প্রতি দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই উপযুক্ত কর্মসূচি দেয়া হবে। এমন কর্মসূচি দেয়া হবে, যার মাধ্যমে এ সরকারের পরিবর্তন আনা সম্ভবপর হবে। পরিস্থিতি বলে দেবে কী ধরনের কর্মসূচি দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে আমরা কিছু দাবি জানিয়েছি। সরকার এসব দাবি মেনে নিয়ে একটি অবাধ নির্বাচনের আয়োজন করবে বলে আশা করছি। আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিলে আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু তারা যদি সে পথে না হাঁটেন তবে যা করার জনগণ তাই করবে। কারণ, এ সরকারের দীর্ঘদিনের দুঃশাসনে মানুষ বিক্ষুব্ধ। তারা আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুত।
জানতে চাইলে বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরিশাল (উত্তর) জেলার সাধারণ সম্পাদক আ ক ন কুদ্দুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। শুধু কেন্দ্র থেকে নির্দেশের অপেক্ষা মাত্র। ইতিমধ্যে কেন্দ্র ঘোষিত সাত দফা দাবি ও ১২ লক্ষ্য সংবলিত ২০ হাজার লিফলেট বরিশাল উত্তরে বিতরণের জন্য পাঠানো হয়েছে। আরও ৩০ হাজার লিফলেট দু-একদিনের মধ্যে পাঠাব।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী যুগান্তরকে বলেন, সাত দফা দাবি ও ১২ লক্ষ্য সংবলিত লিফলেট আমরা সব সাংগঠনিক জেলায় পাঠিয়েছি। এ ছাড়াও জেলা শাখার নেতারাও নিজেদের উদ্যোগে লিফলেট তৈরি করে বিতরণ করছেন।
এদিকে আন্দোলন ও নির্বাচনকে টার্গেট করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। এর অংশ হিসেবে বহিষ্কৃত ও সংস্কারপন্থীদের দলে ফেরানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত নীতিনির্ধারকদের এক বৈঠকে বহিষ্কৃত ও সংস্কারপন্থীদের দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়। যদিও এ সময় কয়েকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য এতে দ্বিমতও পোষণ করেন।
তবে এ সিদ্ধান্ত বিএনপির হাইকমান্ডের জানানো হলে একমত পোষণ করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। সূত্র জানায়, ১৫ অথবা ১৬ অক্টোবর যে কোনো দিন গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অথবা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ ধরনের নেতাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করে নেয়া হতে পারে।