এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : অসহায় দৃষ্টি। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। খালি হাতে সৌদি থেকে ফেরা বাংলাদেশিদের কয়েকজন। ছবিটি শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে তোলা খালি পা। পরনে ময়লা কাপড়। মলিন মুখ। মাথা নিচু করে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আসেন শাহ আলম। ২২ বছর বয়সী এই যুবকের বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলায়। ১ বছর ৫ মাস আগে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন। দেশটিতে যেতে খরচ হয়েছিল সাড়ে ৬ লাখ টাকা। কিন্তু যাওয়ার পর থেকেই ভোগান্তি পিছু ছাড়েনি।
কখনো বেকার, কখনো দিনভিত্তিক চুক্তিতে কাজ করে কোনোরকম থাকা-খাওয়া চলেছে তার। এরই মধ্যে কোনো কারণ ছাড়াই গত ১৯শে সেপ্টেম্বর সৌদি পুলিশ তাকে আটক করে। কাগজপত্র কেড়ে নিয়ে সোজা পাঠিয়ে দেয় সফর জেলে। সেখান থেকেই গতকাল পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে দেশে। তার সঙ্গে ফেরত এসেছে আরো ১৪৯ জন বাংলাদেশি। সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি-৮০৬ নম্বর ফ্লাইটে দুপুর ২টা ১০ মিনিটে তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। এদের কেউ কেউ বিমানবন্দরে নেমেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
ফেরত আসা এই কর্মীদের অভিযোগ, তাদের কাছে সব ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও কোনো কারণ ছাড়াই ধরে ধরে পাঠিয়ে দিচ্ছে দেশে। ফেরত আসা কর্মীদের মধ্যে যেমন রয়েছেন দীর্ঘদিন দেশটিতে অবস্থান করা, তেমনি রয়েছেন অতি সম্প্রতি যাওয়া বাংলাদেশিরাও। জানা গেছে, গত ১০ দিনে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশি দেশে ফিরে এসেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর ৮০ জন, ৩রা আগস্ট ১৪৪ জন, বৃহস্পতিবার ফিরেছেন ১৭০ জন। এছাড়া এর মধ্যেই বিভিন্ন ফ্লাইটে শ’খানেক কর্মী দেশে ফিরেছেন। আগামীকাল আরো ১০০ জনের ফেরত আসার কথা রয়েছে। ফেরত আসা কর্মীরা বলছেন, সামনে তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ধারদেনা করে বিদেশ যাওয়ায় অনেকে বাড়ি ফেরা নিয়েও দোটানায় রয়েছেন। তবে কি কারণে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে এ ব্যাপারে সরকারের দায়িত্বশীল কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গতকাল শাহজালাল বিমানবন্দরে কথা হয় সৌদি ফেরত এসব কর্মীর সঙ্গে। শাহ আলম জানান, তিনি গত বছরের ১৩ই এপ্রিল আপন ফুফাতো ভাইয়ের মাধ্যমে সৌদি আরব যান। তাকে ইলেক্ট্রিকের কাজ দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। বলেছিল, থাকা-খাওয়া খরচ বাদে তার আয়-রোজগার হবে মাসে ৮০-৯০ হাজার টাকা। এই চিন্তা করে তিনি সাড়ে ৬ লাখ টাকা ধারদেনা করে সে দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু দেশটিতে যাওয়ার পর প্রথম ৪ মাস কাটে বেকার জীবন। ওই সময় তিনি কোনরকম একবেলা-আধাবেলা খেয়ে দিন পার করেছেন। এরপর তাকে মরুভূমির একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ দেয়া হয়। সেখানে কাজ করেন ৪-৫ মাস। ওই সময় তিনি বাড়িতে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাও পাঠিয়ে ছিলেন। এরপর আবারো বেকার হয়ে পড়েন। কোম্পানি তাকে দিয়ে কাজ করালেও আর বেতন দেয়নি। এক সময় পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েন। এর মধ্যে পেট চালানো এবং থাকার জন্য মাঝে মাঝে দু’একদিন এদিক-সেদিক কাজ করেন।
কিন্তু তাও নিয়মিত না। এই অবস্থায় গত ১৯শে সেপ্টেম্বর কাজে যাওয়ার সময় সকালে পুলিশ তাকে কোনো কারণ ছাড়াই আটক করে। শাহ আলমের দাবি, তার ভিসার মেয়াদ, বৈধ আকামাসহ সবই ছিল। কিন্তু সেগুলো দেখালেও কোনো কাজ হয়নি বরং কাগজপত্র নিয়ে সফর জেলে পাঠিয়ে দেয়। এরপর সেখানে কাটে ১৬ দিন। ওই জেলেও ছিল কষ্টের জীবন। তিনি বলেন, এই ১৬ দিন এক কাপড়েই ছিলাম। ওই কাপড়েই ফেরত এসেছি। তিনি আরো বলেন, গাদাগাদি করে থাকতে হতো। ফলে পরদিনই অসুস্থ হয়ে পড়ি। তার মতো বেশিরভাগ লোকজনই অসুস্থ হয়ে পড়ে সফর জেলে। কিন্তু কোনো ধরনের চিকিৎসা বা ওষুধপত্র দেয়া হয়নি। শাহ আলম জানান, এখন বাড়ি ফিরবো না। কারণ, পাওনাদাররা তাকে নাজেহাল করবে। তাই আপাতত তিনি ঢাকায় এক বন্ধুর কাছে উঠবেন।
একই ফ্লাইটে আসা বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উত্তরদাত গ্রামের শামীম হোসেন বলেন, তিনি মনজিল ভিসায় সৌদি আরব গিয়েছিলেন ৬ মাস আগে। খরচ হয়েছিল সাড়ে ৫ লাখ টাকা। কিন্তু যাওয়ার পর কপিল (মালিক) আকামা করে দেয়নি। পরে আকামার জন্য ওই কপিলকে আরো ২৪০০ রিয়াল (৫৩ হাজার টাকা) দেন তিনি। আকামাও পান। কিন্তু বৈধ সব কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও পুলিশ তাকে গত ২২ তারিখে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, আমি মদিনা এলাকার একটি দোকানে সাবান কিনতে গেলে পুলিশ ধরে। প্রথমে থানায় এরপর সফর জেলে পাঠায়। সেখান থেকে দেশে। তিনি বলেন, সফর জেলের ১৪ দিন তার জীবনের সবচেয়ে পীড়াদায় ছিল। বলেন, ১৫ জনের থাকার জায়গায় তারা ৯০-১০০ জন রাখে। একবেলা ডাল-ভাত, দুই বেলা ১টা করে রুটি দেয়া হয়। তিনি বলেন, এই ৬ মাসে তিনি ২৪০০ রিয়াল আয় করেছেন যার মধ্যে থাকা-খাওয়াতে প্রতি মাসে ৫০০-৬০০ রিয়াল খরচ হয়েছে। তিনি কাজি এয়ার ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সির মাধ্যমে সৌদি আরব যান বলে জানান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্ছারামপুর থানার আখানগর গ্রামের বাদল মিয়ারও একই অভিযোগ। তিনি ৬ লাখ টাকা খরচ করে ক্লিনার ভিসা নিয়ে সৌদি গেছেন ৩ মাস আগে। সব ধরনের বৈধ কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। কিন্তু পুলিশ সেগুলো কেড়ে নিয়ে তাকে সফর জেলে পাঠায়। একই জেলার নাসির উদ্দিন বলেন, কপিলের সঙ্গে তার মতবিরোধ হওয়ায় তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়। এরপর ২০-২৫ দিন জেলে কেটেছে তার। বলেন, তার কাছেও বৈধ কাগজপত্র ছিল। নাসির অভিযোগ করেন, বাংলাদেশ দূতাবাসের লোকজন সফর জেলে গেলেও তাদের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। বরং তিরস্কার করতেন। তিনি আরো বলেন, তাদের মোবাইল রাখার জন্য ২০ রিয়াল এবং ব্যাগ রাখার জন্য ২৫ রিয়াল পুলিশকে দিতে হয়। অন্যথায় সেগুলো তারা নিজেরাই রেখে দেয়।
চল্লিশোর্ধ নাটোরের জুবায়ের বিমানবন্দরের ২নং টার্মিনালে থেকে বের হয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, দেড় বছর আগে তিনি সৌদি গেছেন। তার আকামার মেয়াদ আছে এখনো ৭ মাস। এই অবস্থায় কোনো কারণ ছাড়াই তাকে আটক করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তার দেশে ফেরত আসার কথা এখনো বাড়ির কেউ জানে না। এই অবস্থায় তিনি বাড়ি ফিরতে চান না। তবে কোথায় যাবেন তাও জানেন না।
এদিকে বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, নারীকর্মীদের সঙ্গে গণহারে পুরুষকর্মী ফেরত আসা শুরু হয়েছে। শাহজালালের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ জানান, সৌদি থেকে ফেরত আসাদের মধ্যে ৬ বছর আগে যাওয়া লোকজন যেমন আছেন, তেমনি সম্প্রতি যাওয়া কর্মীরাও আছেন। তিনি বলেন, ফেরত আসা এসব কর্মী অভিযোগ করছেন, বৈধ কাগজপত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের আটক করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তবে আসল কারণ দূতাবাস বলতে পারবে। কি কারণে তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে- এ ব্যাপারে সরকারে দায়িত্বশীল পর্যায়ের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।