এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মধ্য আফ্রিকান দেশ কঙ্গোর নির্যাতিত নারীদের ভরসাস্থল দেশটির প্রখ্যাত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ডেনিস মুকওয়েগে। তার হাতের কারিশমাও ব্যাপক। নির্যাতিত ও ধর্ষিতা নারীদের ক্ষত অপারেশনের অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় ইতিমধ্যে তিনি দিয়েছেন।এছাড়াও যৌন সহিংসতার শিকার নারীদের ট্রমা থেকে বের করে আনতেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে নারীদের যেমন নিগ্রহের শিকার হতে হয় কঙ্গোতেও এর বিপরীত দেখা যায়নি। নারীদের প্রকাশ্য ধর্ষণ করে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে দুর্বৃত্তরা। নিষ্ঠুর এমন ঘটনাবলী খুবই ব্যথিত করে ডা. মুকওয়েগেকে। কঠোর পরিশ্রম করেছেন নির্যাতিত নারীদের সারিয়ে তুলতে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান তাকে নিয়ে করা এক বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, নারীদের বাঁচাতে দিনে ১০টিরও বেশি অস্ত্রোপচার করেছেন। এজন্য প্রতিদিন ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতে হয়েছে ৬৩ বছর বয়সী এ চিকিৎসককে।
বিবিসি জানায়, তার একক চিকিৎসায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন সহস্রাধিক নারী। আর তার নেতৃত্বাধীন চিকিৎসক দল ৩০ হাজারের বেশি নারীকে চিকিৎসা করে সুস্থ করেছেন। আর মুকওয়েগের হাসপাতালে এখন বছরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৩ হাজার ৫শ’রও বেশি নারী।
কে এই মুকওয়েগে?
১৯৫৫ সালের কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলীয় শহর বুকাভো শহরে জন্মগ্রহণ করেন মুকওয়েগে। ৯ ভাইবোনের সংসারের তৃতীয় সন্তান তিনি।
বর্তমানে কঙ্গোর পূর্বাঞ্চলীয় শহর বুকাভুতে পাঞ্জি হাসপাতালের পরিচালক তিনি।
যুদ্ধক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন সহিংসতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পেয়েছেন কঙ্গোর সার্জন ডেনিশ মুকওয়েগে ও ইরাকের মানবাধিকারী নাদিয়া মুরাদ।
শুক্রবার অসলোতে নরওয়ের নোবেল একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম ঘোষণা করে। আগামী ১০ ডিসেম্বর অসলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন ডা. মুকওয়েগে।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে যেভাবে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ
শৈশবে বাবার প্রেরণায় বেড়ে ওঠা মুকওয়েগে সংকল্প করেন চিকিৎসক হওয়ার। ৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব বুরুন্ডির মেডিকেল স্কুল থেকে এমডি ডিগ্রি নেন। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মজীবনের যাত্রা শুরু করেন। তিনি কঙ্গোর বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণে নিয়োজিত হন। কিন্তু সেখানকার নারীদের দুরাবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন নারীদের জন্য তিনি বিশেষ কিছু করবেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। ফ্রান্সের একটি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন ডা. মুকওয়েগে। ১৯৮৯ সালে তিনি গাইনোকলজি ও অবসট্রেট্রিক্সে ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গাইনোকোলোজি পাস করে এসে নিয়োজিত হন দেশের নিপীড়িত নারীদের কল্যাণে।
ধর্ষিতা নারীদের ভরসাস্থল ডা. মুকওয়েগে
এবার ফ্রান্স থেকে গাইনি ও অবসে উচ্চতর ডিগ্রিধারী এ চিকিৎসক যুদ্ধবিধ্বস্ত কঙ্গোর এক হাসপাতালে কাজ শুরু করেন।
‘১৯৯৯ সালে আমাদের হাসপাতলে প্রথম একজন ধর্ষিতা এলেন। ধর্ষণের পর তার জননাঙ্গ আর উরুতে গুলি করা হয়েছিল। আমি তা দেখে আঁতকে উঠলাম। এরকম নিষ্ঠুরতা মানুষের দ্বারা কীভাবে সম্ভব ‘ -বলেন ডা. মুকওয়েগে।
তিনি আরও জানান, ওই ঘটনার তিন মাস পর একই ধরনের নির্মমতার শিকার ৪৫ জন নারী এলেন আমার হাসপাতালে। তাদের সবার গল্প মোটামুটি এক। গ্রামে হামলা চালিয়ে তাদের ধর্ষণ করা হয়, নির্যাতন করা হয়। অনেক নারী এসেছিলেন পোড়া ক্ষত নিয়ে। তাদের প্রথমে ধর্ষণ করা হয়েছিল, তারপর জননাঙ্গে ঢেলে দেওয়া হয়েছিল এসিড!
নিষ্ঠুর এসব ঘটনা খুবই পীড়া দেয় ডা. মুকওয়েগেকে।
তিনি বলেন, ‘এগুলো (ধর্ষণ) কেবল বিচ্ছিন্ন সহিংসতা নয়, এগুলো দুর্বৃত্তদের একটি কৌশল। একই সময়ে একাধিক নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলেন। কোনো কোনো রাতে পুরো গ্রামের সব নারীকে ধর্ষণ করা হচ্ছিল। এই বর্বরতা চলছিল সবার সামনে, প্রকাশ্যে। এর মাধ্যমে তারা যে কেবল সেই নারীদের ক্ষতি করছিল তা নয়, পুরো গোষ্ঠীকে ক্ষত সৃষ্টি করছিল।
এই কৌশলের ফল হচ্ছিল এরকম- পুরো গ্রামের মানুষ তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে, ক্ষেত খামার ও সম্পদসহ সবকিছু ছেড়ে পালাচ্ছিল। দারুণ কার্যকর এক কৌশল!
প্রতিবাদী চিকিৎসক
চিকিৎসকদের দায়িত্ব সেবা দেয়া, রোগীকে সুস্থ করে তোলা। কিন্তু শুধু সেবা দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি ডা. মুকওয়েগে। তিনি মনে করেছেন, ধর্ষণের মতো জঘন্য অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলাও তার কর্তব্য। প্রবল সাহসী এ চিকিৎসক যুদ্ধক্ষেত্রে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে তীব্র এক প্রতিবাদী মানুষও। অসহায় এ নারীদের জন্য বিশেষ কিছু না করার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্যাপকভাবে সমালোচনা করেছেন তিনি। এর প্রতিকারে কঙ্গো সরকারের নির্লিপ্ততাকেও ঘৃণাভরে দেখেন তিনি। সরাসরি কঙ্গো সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সেমিনারে বক্তব্য দেন।
২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে এক ভাষণে মুকওয়েগে অন্যায় যুদ্ধ এবং যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে নারীদের ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য কঙ্গো সরকারসহ অন্যান্য দেশের সরকারেরও সমালোচনা করেন।
এরপরই তার জীবন হুমকির মধ্যে পরে। বন্দুকধারীরা তাকে টার্গেট করে। একবার তার ওপর ভয়াবহ হামলাও করে তারা। ভাগ্যের কারণে এ ঘটনায় নিজে প্রাণে বেঁচে যান, তবে তার দেহরক্ষী সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন।
এ ঘটনার পর মুকওয়েগে পরিবার নিয়ে চলে যান সুইডেনে। এরপর বেলজিয়ামে।
কিন্তু দেশের জন্য, নির্যাতিত নারীদের জন্য তার মন বিদেশে বেশিদিন টিকল না। জীবনের ঝুঁকি সত্ত্বেও ২০১৩ সালে তিনি আবার দেশে ফেরেন। দেশের নারীরাই প্রচার চালিয়ে তহবিল সংগ্রহ করে তার দেশে ফেরার টিকিটের ব্যবস্থা করে দেয়।
কিন্তু তার জীবন আর স্বাভাবিক নেই। হাসপাতালেই তাকে থাকতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। বলা যায়, এখন হাসপাতালেই তিনি স্বেচ্ছা বন্দিত্ব গ্রহণ করেছেন।
সিএনএনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মুকওয়েগে বলেন, “দেশে ফেরার পর আমার লাইফস্টাইল পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখন আমি সব সময় হাসপাতালেই থাকি। আর কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রেখেছি। তাই স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগটাও তেমন নেই।”
মুকওয়েগের হাসপাতালে বর্তমানে তার সুরক্ষায় নিয়োজিত আছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীরা।
নিজের হাসপাতাল সম্পর্কে বলতে গিয়ে আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ২০১৩ সালে বিবিসি কে তিনি বলেন, “আমি তাঁবু খাটিয়ে হাসপাতালের যাত্রা শুরু করেছিলাম। গর্ভবতী নারীদের জন্য একটি ওয়ার্ড এবং আর একটি অপারেশন থিয়েটার ছিল। ১৯৯৮ সালে ফের সব ধ্বংস হল। ১৯৯৯ সালে আমি আবার সব নতুন করে শুরু করলাম।”
অপারেশন থিয়েটারেই নোবেলের খবর
শুক্রবার নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণার সময় মুকওয়েগে অপারেশন থিয়েটারে ছিলেন।
তার কথায়, “অপারেশন করতে করতেই এ খবর এল। আমি লোকজনের চীৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার এ সম্মানজনক পুরস্কারের খবর শুনে নারীরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। আমি তাদের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখেছি। আমার কাজের স্বীকৃতিতে তারা যে রকম খুশী হয়েছে তা সত্যিই আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।”
ডা. ডেনিস মুকওয়েগে সম্পর্কে নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান
এ বছর শান্তিতে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পান কঙ্গোর চিকিৎসক ডা. ডেনিস মুকওয়েগে ও ইরাকের কুর্দি মানবাধিকার কর্মী নাদিয়া মুরাদ। শুক্রবার (অক্টোবর) আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের নাম ঘোষণা করে নরওয়ের নোবেল কমিটি।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান বেরিট রেইস-অ্যান্ডারসন বলেন, ধর্ষণের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নাদিয়া মুরাদ-ডেনিস মুকওয়েজ জুটির ভূমিকা ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ ছিল।
ডা. মুকওয়েগের জীবনের যত অর্জন
দীর্ঘ সময় ধরে নারীদের সেবায় এক লড়াকু এ চিকিৎসকের জীবনী এবং কাজ নিয়ে নির্মিত হয়েছে ২০১৫ সালের ‘দ্যা ম্যান হু মেন্ডস উইমেন’ শীর্ষক চলচ্চিত্র।
২০০৮ সালে মুকওয়েগে জাতিসংঘের মানবাধিকার পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে তিনি ‘আফ্রিকান অব দ্য ইয়ার’ হন।
স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ মুকওয়েগে গত ১০ বছর ধরেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন।