এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : রাজনীতি এখন গরিবের বউয়ের মতো হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তনে দেয়া বক্তৃতায় অবসর নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে আসার প্রবণতায় উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। লিখিত বক্তব্যের বাইরে তিনি এ নিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় তার অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ (ভাবি)। রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। যে কেউ যেকোনো সময় ঢুকে পড়তে পারে, বাধা নেই। আমি যদি বলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের লেকচারার হইতাম চাই, নিশ্চয়ই ভিসি সাহেব আমারে নেবেন না। বা কোনো হাসপাতালে গিয়া বলি, এতদিন রাজনীতি করছি, হাসপাতালে ডাক্তারি করতে দেন। বোঝেন অবস্থাটা কী হবে? এগুলো বললে হাসির পাত্র হওয়া ছাড়া আর কিছু হবে না।
যদি বলি এত বছর রাজনীতি করছি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সুপারিনটেনডেন্টের পদ দিতে পারো। সেখানে আমাকে দিবে? কিন্তু রাজনীতি গরিবের ভাউজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের উদ্দেশে আবদুল হামিদ বলেন, ভিসি সাহেবও অবসরের পর রাজনীতি করবেন। যারা সরকারি চাকরি করেন, জজ সাহেব যারা আছেন ৬৭ বছর চাকরি করবেন। রিটায়ারের পর বলবেন, ‘আমিও রাজনীতিবিদ’।
আর্মির জেনারেল হওয়া, সেনাপ্রধান হওয়া, সরকারি সচিব, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, কেবিনেট সেক্রেটারি রিটায়ার কইরা বলেন, আমি রাজনীতি করবো।’ কোনো রাখঢাক নাই। যার ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা তখনই রাজনীতিতে ঢোকে। চাকরি করে যা করার করছে। এরপর বলছে- রাজনীতি করবো। আমার মনে হয় সকল রাজনৈতিক দলকে এটা চিন্তা করা উচিত। হ্যাঁ এক্সপার্টের দরকার আছে। অনেক সময় বলা হয় পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট। হ্যাঁ পেশাভিত্তিক করেন। এমবিবিএস পাস করে সরাসরি রাজনীতি করেন। কোনো অসুবিধা নেই। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে চাকরিতে না ঢুকে সরাসরি রাজনীতিতে ঢোকেন।
প্রেসিডেন্ট বলেন, ৫৯ বছর, ৬৫ বছর, ৬৭ বছর পুলিশের ঊর্ধ্বতন ডিআইজি, আইজিরাও রাজনীতি করবেন। মনে মনে কই, রাজনীতি করার সময় এই পুলিশ তোমার বাহিনী দিয়ে পাছার মধ্যে বাড়ি দিছো। তুমি আবার আমার লগে আইছো রাজনীতি করতে। কই যামু। রাজনৈতিক দলগুলোকে এসব ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। এই যে রাজনীতিবিদদের সমস্যা এই সমস্যার কারণও এটা। বিজনেসম্যানরা তো আছেই… শিল্পপতি-ভগ্নিপতিদের আগমন এভাবে হয়ে যায়। এগুলো থামানো দরকার। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির শিক্ষা নেয়ার ওপর জোর দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, এক্সপার্টের প্রয়োজন আছে। এক্সপারটাইজ হিসেবে তাদের মতামত নেন। তাদের কমিটি করে দেন, উপদেষ্টা করে দেন। ডাইরেক্ট রাজনীতির মধ্যে আইসা তারা ইলেকশন করবে, মন্ত্রী হয়ে যাবে- এটা যেন কেমন কেমন লাগে। এর জন্যই আমার মনে হয় আমাদের দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হচ্ছে না।
ডাকসু নির্বাচন নিয়ে আশার আলো দেখছি। ছাত্র সমাজের কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাই। যখন তফসিল হয়, দেখা যাবে অনেক ক্যালকুলেশন হবে। ভেজাল সৃষ্টি করে দিতে পারে। অনেকে অনেক স্বার্থে করতে পারে। কিন্তু সমস্ত ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করা উচিত না। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এই সমাবর্তনে রেজিস্ট্র্রেশন করেন ২১ হাজার ১১১ জন গ্র্যাজুয়েট। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অংশগ্রহণ। কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৯৬টি স্বর্ণ পদক, ৮১ জনকে পিএইচডি ও ২৭ জনকে এম ফিল ডিগ্রি দেয়া হয় সমাবর্তনে। অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তব্য দেন জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। আরো বক্তব্য দেন ভিসি মো. অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ।
শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বঙ্গভবনে এলেন না: বক্তৃতায় উপস্থিত গ্রাজুয়েটদের সামনে রসিকতাও করেন প্রেসিডেন্ট। ভারতীয় অভিনেত্রী প্রিয়াংকা চোপড়ার বাংলাদেশ সফর নিয়ে রসাত্মক কথা বলতে হাসিতে ফেটে পড়ে পুরো অনুষ্ঠানস্থল। প্রেসিডেন্ট বলেন, সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে দশ বছরের ছোট নিককে বিয়ে করলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। কিন্তু যদি রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরকালে বঙ্গভবনে আসতেন তাহলে অন্যরকমের কিছু ঘটতেও পারতো। প্রেসিডেন্ট বিবাহিত জীবনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, আমি বিয়ে করেছি বিরানব্বই হাজার চারশ’ সেকেন্ড হয়ে গেছে।
আসলে আমাদের বিয়ের ৫৪ বছর দুইদিন হয়েছে। তার কারণ কম বয়সে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। এই ৫৪ বছরের বিবাহিত জীবনে একজন মহিলা আমার সব কিছু বুঝে ফেলেছে। আমি কী ভালো, কী মন্দ করতে পারি। এটি কিন্তু তার কন্ট্রোলের ভেতরে। আমি যখন সাত আট বছর আগে স্পিকার ছিলাম তখন নারী নির্যাতন বিল পাস করার সময় কিন্তু সংসদে পুরুষ নির্যাতন বিল পাস করা দরকার বলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, এটা এখন প্রয়োজন নাই। যদি হয় তখন দেখা যাবে। প্রায় ছয় বছর চলে গেছে এখনো আইনটি পাস করে নাই। প্রধানমন্ত্রীরা তো খবর রাখেন না। শুধু আমার ঘরে না। সারা বাংলাদেশে যে পুরুষ নির্যাতন হচ্ছে না তা নয়। কিছুটা হলেও হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা টের পাচ্ছে। উদাহরণ টেনে প্রেসিডেন্ট বলেন, কয়েক মাস আগে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফরে ঢাকায় এসেছিল।
সাধারণত বিদেশি অতিথিরা ঢাকায় এলেই বঙ্গভবনে আসেন। আমি স্ত্রীকে বললাম প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আসবে। আসার একদিন আগে তাকে বলেছি। পরে শুনেছি আমার স্ত্রী নাকি প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোন করে বলেছে প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বঙ্গভবনে আসার দরকার কি? এটা তো ষড়যন্ত্র। শেষ পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা চোপড়া আর বঙ্গভবনে আসেনি। তার কয়েক মাস পরে শুনলাম আমেরিকায় নিক নামে তার চেয়ে দশ বছরের ছোট এক ছেলেকে বিয়ে করেছে প্রিয়াঙ্কা। আমি তার চেয়ে ৩০/৩৫ বছরের বড়। তো দশ-বারো বছরের নিচে যদি সে নামতে পারে। তাহলে তো ৩০, ৩৫, ৪০ বছরের উপরেও তো সে উঠতে পারতো। এ রকম সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হয় নি। অন্তত এই উপমহাদেশের একটা মেয়ে যদি আসতো, কোনো ঘটনা ঘটতো তাহলে তো সুদূর সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে তাকে আমেরিকায় নাও যেতে হতো। সবই কপাল।
নেতৃত্বে আসতে হবে তরুণদের: লিখিত বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ জাতির পিতার স্বপ্ন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে জাতি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দিতে তরুণদের, বিশেষ করে সদ্য গ্রাজুয়েটদের প্রতি আহ্বান জানান। বলেন, আমরা শুধুমাত্র আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়েছে, কিন্তু দেশ গড়ার সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। ক্ষুধা ও নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়া না হওয়া পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। প্রেসিডেন্ট গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে বলেন, তোমরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামীতে তোমরাই দেশ পরিচালনা করবে। তোমাদের সঠিক নেতৃত্বে দেশ হবে উন্নত, সমৃদ্ধ। জীবনে চলার পথে তোমাদের আদর্শ থাকতে হবে। সে আদর্শ হবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে। তোমরা কখনো সত্যের সঙ্গে মিথ্যার, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের আপস করবে না।
প্রেসিডেন্ট ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির তুলনা করে বলেন, ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণ আদর্শভিত্তিক। সেখানে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ মুখ্য ছিল না। প্রেসিডেন্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিপ্লোমা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের উল্লেখ করে ডিপ্লোমার নামে ডিগ্রি দেয়া যায় কিনা এবং সান্ধ্যকালীন কোর্সে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ও ঐতিহ্য ব্যাহত হয় কিনা, সে বিষয়টি ভেবে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ছাত্রদের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করতে হবে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থের বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির প্রত্যাশা পূরণে সর্বদাই একজন চালকের ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি সময়ের চাহিদা এবং বৈশ্বিক জনশক্তির বাজারের কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন বিভাগ সমপ্রসারণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।