এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ আসনের মধ্যে সবচেয়ে কম ভোটার ঝালকাঠি-১ আসনে রাজাপুর ও কাঁঠালিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে ভোটার সংখ্যা ১ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮৫ জন। অপরদিকে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোটার ঢাকা-১৯ আসনে।
চারটি ইউনিয়ন বাদে সাভার উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে ভোটার সংখ্যা ৭ লাখ ৪৭ হাজার ৩০১ জন। ঝালকাঠি-১ আসনের চেয়ে ঢাকা-১৯ আসনে ভোটার সংখ্যা চারগুণের বেশি। আরপিও অনুযায়ী আসন্ন নির্বাচনে উভয় আসনের প্রার্থীরা ভোটাদের জন্য সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা ব্যয় করতে পারবেন।
এ হিসাবে ঝালকাঠি-১ আসনের প্রার্থী ভোটারপ্রতি সর্বোচ্চ ১৪ টাকা, অপরদিকে ঢাকা-১৯ আসনের প্রার্থী সর্বোচ্চ ৩ টাকা ৩৪ পয়সা খরচের সুযোগ পাবেন। বাস্তবে এ টাকায় নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা।
এ প্রেক্ষাপটেও আগামী নির্বাচনে আসনভিত্তিক প্রার্থীর জন্য নতুন করে ব্যয় নির্ধারণে নির্বাচন কমিশন (ইসি) কোনো উদ্যোগ নেয়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ভোটার সংখ্যার অনুপাতে ব্যয় নির্ধারণ না করলে কালো টাকার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এর আগে নির্বাচনে ব্যয় মনিটরিং এবং প্রার্থীর দেয়া ব্যয়ের হিসাব অডিট করার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছিল ইসির আইন সংস্কার কমিটি। ওই কমিটি গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৪৪ ধারায় নতুন দুটি উপধারা সংযোজনেরও প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু ইসি তা আমলে নেয়নি।
নির্বাচনী ব্যয় মনিটরিং বিষয়ে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে হলফনামায় যেসব তথ্য দেয়া হয়, সেটিই পরীক্ষা করা হয় না। নির্বাচনের ব্যয় সঠিকভাবে মনিটরিং করা হবে সেটি আশা করব কিভাবে? তিনি বলেন, ভারতের এক রাজ্যের কর্মকর্তাদের অন্য রাজ্যে পাঠিয়ে প্রার্থীদের ব্যয় মনিটরিং করা হয়। আমাদের দেশেও ব্যয় মনিটরিংয়ের জন্য একটি ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু বিগত দিনগুলোতে নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি ব্যয়ের ঘটনায় কাউকে সাজা দেয়া হয়েছে এমনটি শুনিনি। এর ফলে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব ও বাড়তি ব্যয়ের প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে।
নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধে ব্যয় মনিটরিংয়ের ব্যাপারে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন মহল থেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। প্রার্থীর যোগ্যতার চেয়ে নির্বাচনে টাকার প্রভাব যেন বড় না হয়ে ওঠে এবং কোনো প্রার্থী যাতে নির্ধারিত অঙ্কের বেশি টাকা ব্যয় করতে না পারেন সে জন্য ওই প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সে ব্যাপারে এখন পর্যন্ত ইসিকে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে প্রার্থী নির্বাচনের পর ব্যয়ের যে হিসাব জমা দেবে সেটিই বিশ্বাস করতে হবে ইসিকে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান আইনে নির্বাচনের ব্যয় মনিটরের যে বিধান রয়েছে আমরা সেটাই অনুসরণ করব। এর বাইরে আমাদের করণীয় কিছু নেই।
ইসি সচিবালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি ভোটার তালিকার সিডি মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কার্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকা ধরেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাঠ পর্যায়ে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে সেখানে দেখা গেছে, দুটি আসনে ভোটার সংখ্যা সাড়ে সাত লাখের কাছাকাছি। এছাড়া দুটি আসনে ছয় লাখের বেশি, অন্তত ৮টি আসনে ৫ লাখ থেকে ছয় লাখ পর্যন্ত ভোটার রয়েছে। অপরদিকে চারটি আসনে ভোটার সংখ্যা দুই লাখের কম। চার লাখের বেশি ভোটার রয়েছে ৫০টি আসনে। বাকি আসনগুলোতে দুই থেকে তিন লাখের বেশি ভোটার রয়েছে। আরও জানা গেছে, এ তালিকা তৈরির পর যারা ভোটার তালিকাভুক্ত হবেন অথবা ভোটার এলাকা পরিবর্তন করবেন, তাদের জন্য সম্পূরক ভোটার তালিকা তৈরি করা হবে।
তবে নির্বাচন কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, গত নির্বাচনে ভোটার প্রতি মাথাপিছু ব্যয় ৮ টাকা এবং প্রার্থীর জন্য সর্বোচ্চ ব্যয় ২৫ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল ইসি। কিন্তু ওই হারে প্রার্থীরা টাকা ব্যয় করেছিল কিনা তা মনিটরিংয়ে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি। তারা বলেন, আরপিওতে একজন প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয় ২৫ লাখ টাকা। কিন্তু বাস্তবে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বড় দলগুলোর প্রার্থীরা। কিন্তু সাধারণত বাড়তি ব্যয় মনিটরিং বা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়া হয় না, কাউকে সাজা দেয়া হয় না। এবারও ব্যয় মনিটরিংয়ে গতানুগতিকের বাইরে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তুতি নেই। একজন আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ব্যয় মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়।
কিন্তু সংসদ নির্বাচনে সে অর্থে কোনো কমিটিও থাকে না। মনোনয়নপত্রের সঙ্গে থাকা পৃথক ফরমে প্রার্থী সম্ভাব্য ব্যয়ের খাত ও ভোটের পর যে হিসাব দেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের। ওই কর্মকর্তা বলেন, যে আসনে ভোটার সংখ্যা কম, আর যে আসনে বেশি এ দুই আসনের খরচ কখনই এক হবে না। বেশি ভোটারসংখ্যক এলাকার জন্য বেশি টাকা খরচ হবে।
জানা গেছে, এবারের ভোটার তালিকায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটার রয়েছে গাজীপুর-২ আসনে। এখানে ভোটার সংখ্যা ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৪১ জন। এছাড়া ছয় লাখের বেশি ভোটার রয়েছে গাজীপুর-১ (৬ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৪) ও নারায়ণগঞ্জ-৪ (৬ লাখ ৫১ হাজার ১২৩) আসনে। পাঁচ লাখের বেশি ভোটার রয়েছে- যশোর-৩ (৫ লাখ ২২ হাজার ৫৬১), ময়মনসিংহ-৪ (৫ লাখ ৫৬ হাজার ৯৯৬), ঢাকা-১৮ (৫ লাখ ৫৫ হাজার ৭১৩), সিলেট-১ (৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (৫ লাখ ১৫ হাজার ১১ জন), কুমিল্লা-১০ (৫ লাখ ১৬ হাজার ৩৯৪), নোয়াখালী-৪ (৫ লাখ ৪৪ হাজার ৩২৯) ও চট্টগ্রাম- ১১ (৫ লাখ ৭ হাজার ৩৫৫) আসনে।
অপরদিকে চার লাখের বেশি ভোটার রয়েছে- ঠাকুরগাঁও-১ (৪ লাখ ২২ হাজার ১২৪), দিনাজপুর-৬ (৪ লাখ ৬৬ হাজার ১৭২), রংপুর-৩ (৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৩), রংপুর-৪ (৪ লাখ ১২ হাজার ৯৫৯), কুড়িগ্রাম-১ (৪ লাখ ৬১ হাজার ৪১৬), কুড়িগ্রাম-২ (৪ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩৬), গাইবান্ধা-৩ (৪ লাখ ১১ হাজার ৯৪২), বগুড়া-৫ (৪ লাখ ৭৫ হাজার ৫৪৭) ও বগুড়া-৭ (৪ লাখ ৬১ হাজার ৪৭১)।
আরও আছে- চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (৪ লাখ ১৬ হাজার ৫৪), নওগাঁ-১ (৪ লাখ ২ হাজার ৬০০), সিরাজগঞ্জ-৬ (৪ লাখ ১ হাজার ১৫৫), পাবনা-৩ (৪ লাখ ২ হাজার ৭৭৪), পাবনা-৫ (৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৮৫), চুয়াডাঙ্গা-১ (৪ লাখ ৩৭ হাজার ৭৭১), চুয়াডাঙ্গা-২ (৪ লাখ ১৪ হাজার ৯৮৬), ঝিনাইদহ-২ (৪ লাখ ২৩ হাজার ৫২৩), যশোর-২ (৪ লাখ ৫ হাজার ৭৩৩), সাতক্ষীরা-১ (৪ লাখ ২৩ হাজার ৩২), বরগুনা-১ (৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৮২), পিরোজপুর-১ (৪ লাখ ১৮ হাজার ৯৭৪), জামালপুর-৩ (৪ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০), জামালপুর-৫ (৪ লাখ ৬৯ হাজার ৮১৮) ও ময়মনসিংহ-২ (৪ লাখ ৫০ হাজার ৩৬০)। এ তালিকায় আছে কিশোরগঞ্জ-১ (৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৪), কিশোরগঞ্জ-২ (৪ লাখ ১৭ হাজার ২৬৫), মানিকগঞ্জ-২ (৪ লাখ ৬ হাজার ১৯৫), মুন্সীগঞ্জ-১ (৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৫০), মুন্সীগঞ্জ-৩ (৪ লাখ ১৬ হাজার ৫৪১), ঢাকা-১ (৪ লাখ ৪০ হাজার ৪০৭), ঢাকা-২ (৪ লাখ ৯৪ হাজার ৩১৩), ঢাকা-৫ (৪ লাখ ৫০ হাজার ৭২৫), ঢাকা-৯ (৪ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১), ঢাকা-১১ (৪ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৫), ঢাকা-১৪ (৪ লাখ ৬ হাজার ৫৩৪)। গাজীপুর-৩ (৪ লাখ ৩৬ হাজার ৬৪৩), রাজবাড়ী-২ (৪ লাখ ৬২ হাজার ১৩৮), ফরিদপুর-১ (৪ লাখ ২২ হাজার ৬৮৫), সুনামগঞ্জ-৫ (৪ লাখ ১৫ হাজার ৮৮৫), হবিগঞ্জ-৪ (৪ লাখ ২৭ হাজার ৫২৫), কুমিল্লা-৬ (৪ লাখ ১৫ হাজার ৮০১), চট্টগ্রাম-৫ (৪ লাখ ৩০ হাজার ২৭), চট্টগ্রাম-৮ (৪ লাখ ৮৩ হাজার ১৪৫), চট্টগ্রাম-১০ (৪ লাখ ৬৯ হাজার ২৪৬), কক্সবাজার-৩ (৪ লাখ ১৪ হাজার ১৮৫), পার্বত্য খাগড়াছড়ি (৪ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৩) ও পার্বত্য রাঙ্গামাটি (৪ লাখ ১৮ হাজার ২১৫)।
আরপিও সংশোধনের সুপারিশ আমলে নেয়নি ইসি : জানা গেছে, ইসির সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন মহল সংলাপে নির্বাচনে ব্যয় নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তারা নানান ধরনের প্রস্তাবও দেন। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারাও আরপিও সংশোধনের বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওইসব প্রস্তাবের আলোকে ইসির আইন সংস্কার কমিটি আরপিওতে ৪৪বি(৬) ও ৪৪সি(৪) নামক দুটি উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করেন। ৪৪বি(৬)-এ বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিটি আসনে একটি করে মনিটরিং কমিটি থাকবে। ওই কমিটি প্রার্থীদের ব্যয় মনিটর করবে। এছাড়া প্রতি সপ্তাহ শেষে প্রার্থীরা ব্যয়ের রিপোর্ট দেবেন। ওই রিপোর্ট ও কমিটির পর্যবেক্ষণসহ তা ইসিতে পাঠাবেন। এছাড়া ৪৪সি(৪)-এ নির্বাচনে অবৈধ টাকার প্রভাব রোধ, নির্বাচনী ব্যয় নির্ধারিত টাকার মধ্যে রাখা এবং ব্যয় যথাযথভাবে করা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য অডিট কমিটি গঠনের বিধান সংযোজনের সুপারিশ করা হয়। কিন্তু কমিশন এসব প্রস্তাব আমলে না নিয়েই আরপিও সংশোধনের সুপারিশ আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়।