এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্রবাসী সন্তানদের পড়াশোনার জন্য ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতিমধ্যে সৌদি আরব ও বাহরাইনে চারটি স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। আর জর্ডান, লেবানন, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রুনাইয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১৫০ কোটি টাকার চাহিদা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সৌদি আরবে চারটি ও বাহরাইনে ১টি স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সৌদি আরবে তিনটি স্কুলের জন্য অর্থ ছাড় হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওমান, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে স্কুল স্থাপনে উদ্যোগ নেয়া হবে। এসব স্কুল স্থাপনের অর্থায়ন করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদারের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সৌদিতে স্কুল স্থাপনের জন্য রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসকে ইতিমধ্যে ১০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচ কোটি ৭৭ লাখ টাকায় রিয়াদে দুইটি এবং জেদ্দায় ১টিসহ মোট তিনটি স্কুলের অনুকূলে গত অর্থবছরে দেয়া হয়েছে। বাকি আরো চার কোটি ২৩ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সৌদির দাম্মামে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য দূতাবাসের চাহিদা মোতাবেক আরো ১৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আর বাহরাইনে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত সময়ে শুরু হবে।
এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে সদ্য বিদায়ী সচিব ড. নমিতা হালদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় মধ্যপ্রাচ্যে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে ইতিমধ্যে অর্থ ছাড় হয়েছে। তবে, কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে যেসব স্কুল করা হবে তা বাংলাদেশ দূতাবাসের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হবে এটি নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমি পর্যবেক্ষণ দিয়ে এসেছি। এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার পর তাদের অগ্রগতির প্রতিবেদন দেখে অন্যান্য দেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সৌদি আরব সফরকালে সৌদি আরবে স্থাপিত বাংলা স্কুলগুলোর জন্য নিজস্ব জমি কিনে স্কুল স্থাপনের জন্য নির্দেশ দেন। এর পরপরই সৌদি আরবের সাতটি স্থানে ৯টি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য মোট ৬৩৬ কোটি ১২ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় ধরে একটি উন্নয়ন প্রকল্প পরিকল্পনা (ডিপিসি) মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্প মেয়াদ ধরা হয় ২০১৭ সালে জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। এরপর পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করে রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পুনরায় ব্যয় প্রাক্কলন করার সুপারিশ করা হয়। পরে ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট দেয়া হয়। এর রিপোর্টের আলোকে ডিপিপি পুনর্গঠিত করে সৌদি আরবে সাতটি স্থানে ৯টি স্কুলের পরির্বতে মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি দেশে মোট চারটি করে স্কুল (সৌদি আরবের রিয়াদ জেদ্দা, বাহরাইন এবং ওমান) প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়।
এরপর চলতি বছর জুন মাসে মধ্যপ্রাচ্যের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য ১০টি দেশের দূতাবাসের কাছে চাহিদাপত্র চাওয়া হয়। সেখানে স্কুলের জন্য জমির পরিমাণ, মূল্য, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সংখ্যা কত, শিক্ষক কর্মচারীদের বেতনভাতা, স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি এবং স্কুলটি টেকসই হবে কী না ইত্যাদি বিষয় জানতে চাওয়া হয়। এর মধ্যে সাতটি দেশ সৌদি আরব, জর্ডান, লেবানন, বাহরাইন, লিবিয়া, ইরাক, ব্রুনাইস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস চাহিদা দিয়েছে। ওমান, কুয়েত এবং সংযুক্ত আবর আমিরাত থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চাহিদা পাওয়া যায়নি।
প্রবাসী মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মিশন থেকে আপাতত ছয়টি স্কুল (সৌদি আরবের রিয়াদ, জেদ্দা, মদিনা মুনওয়ারা, বাহরাইন এবং লিবিয়া) জন্য প্রায় ১৫০ কোটি টাকার চাহিদা পাওয়া গেছে। তবে, লিবিয়ায় বর্তমানে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করায় সেখানে আপাতত কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই।
চলতি বছর এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী আবার সৌদি আরব সফরকালে সৌদির দাম্মামে স্কুল নির্মাণের জন্য তাগিদ দেয়। এসব স্কুল স্থাপনের প্রবাসী মস্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তহবিল থেকে অর্থায়নের জন্য নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বার তাগাদার পর গত ৪ই সেপ্টেম্বর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদারের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক ডাকা হয়। সেখানে অর্থ, শিক্ষা, পররাষ্ট্র, প্রবাসী কল্যাণ এবং পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, সৌদি আরবের দাম্মামে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, তাই পাইলট প্রকল্প হিসেবে দাম্মামে একটি প্রতিষ্ঠা করা যায়। পরবর্তীতে অন্যান্য স্থানে পর্যায়ক্রমে স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হবে। ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক গাজী মো. জুলহাস এ প্রস্তাবের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দাম্মামে কল্যাণ বোর্ডের অর্থায়নে স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ এখনই শুরু করা যায়। তবে পরবর্তীতে অন্যান্য স্কুল স্থাপনের বিষয়ে তিনি ফিজিবিলিটি স্টাডি করে তার ভিত্তিতে স্কুল প্রতিষ্ঠা করার পরামর্শ দেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, ফিজিবিলিটি স্টাডি ভালোভাবে করতে হবে। যাতে ওইখানকার বাস্তব চিত্র ও নিরপেক্ষ হয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সংস্থা) নারায়ণ চন্দ্র বর্মা বলেন, বাহরাইনে বাংলাদেশ কমিউনিটি যে স্কুল করছে সেখানে ১২০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। স্কুলের জন্য বাহরাইন সরকার যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে তাতে চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে স্কুলের অবকাঠামো স্থাপন না করলে জায়গা বাহরাইন সরকার বাতিল করবে। তাই বাহরাইনে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্কুলভবন স্থাপন করা দরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটি কীভাবে স্কুলগুলো চালাচ্ছে তা আরো বিস্তারিত জানতে হবে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, বিদেশে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষামন্ত্রণালযের আপাতত কোনো নীতিমালা নেই। তবে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশে কমিউনিটির লোকজন আটটি স্কুল পরিচালিত করছে। যেগুলো বাংলাদেশে কারিকুলাম অনুসরণ করে এবং শিক্ষার্থীরা ঢাকা বোর্ডের অধীনে পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। তবে, সেখানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় স্কুল করলে সব ধরনের সহযোহিতা করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ই সেপ্টেম্বরের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সাতটি সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় সৌদি আরবে রিয়াদ, জেদ্দা, মদিনা মুনওয়ারা ও দাম্মাম এবং বাহরাইনে দূতাবাসের ব্যবস্থাপনায় জমি কেনা ও ভবন নির্মাণের জন্য যে টাকা প্রয়োজন তা ওয়েজ আর্নার্স বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন নিতে হবে। দাম্মামে জমি কেনার জন্য দূতাবাসের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তবে, বোর্ডের নামে জমি কেনা ও ভবন নির্মাণে জন্য পৃথক প্রাক্কলন দিতে হবে দূতাবাসকে। দূতাবাসের নেতৃত্বে একটি পিআইসি কমিটি স্কুল ভবন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। তার সঙ্গে শ্রম কল্যাণ উইং এ কমিটির সদস্য সচিব থাকবে। পুরো ব্যয় আর্নার্স বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়াও আর্নার্স বোর্ডের মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি টিম এসব স্কুল প্রতিষ্ঠার কাজ সরজমিন পরিদর্শনের জন্য দ্রুত মধ্যপ্রাচ্যে সফর করার সিদ্ধান্ত হয়।