এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যা ইস্যুতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুদিক থেকেই চরম চাপে সৌদি আরব। এ ঘটনায় বিভিন্ন দেশের নেতারা, ব্যবসায়ী ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা সৌদি আরব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে দেশটি যে তেলনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে চেয়েছিল, তা এখন ঝুঁকির মুখে। অনেক দেশ, ব্যবসায়ী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভিশন-২০৩০ পরিকল্পনার বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিচ্ছেন।
খাসোগি খুনের ঘটনায় চলতি মাসের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় বিনিয়োগবিষয়ক সম্মেলন যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশ, কোম্পানি ও ব্যবসায়ী। ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর রিয়াদে ‘দাভোস ইন দ্য ডেজার্ট’ শীর্ষক ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এফআইআই) কনফারেন্স হওয়ার কথা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ড ও ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগ সম্মেলন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্টিভ মিউচিন ও ব্রিটেনের বাণিজ্যমন্ত্রী লিয়াম ফক্স এ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। এছাড়া আইএমএফের পক্ষ থেকেও নিশ্চিত করা হয়েছে যে, সংস্থাটির প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দ সৌদি আরবে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন না।
ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন এর মধ্যে লোহিতসাগরকেন্দ্রিক পর্যটনবিষয়ক দুটি প্রকল্প থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, মহাশূন্যবিষয়ক কোম্পানিতে ১০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিয়ে সৌদি সরকারের সঙ্গে তার যে আলোচনা চলছিল, তা থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, সৌদি আরবের ‘এ সরকার নিয়ে উচ্চাশা ছিল…উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে নিয়েও উচ্চাশা ছিল। তুরস্কে যা ঘটেছে শোনা যাচ্ছে তা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের পশ্চিমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কো. ও গাড়ি নির্মাতা ফোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা সৌদি আরবের বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ দেবেন না। রাইড শেয়ারিং কোম্পানি উবারও এ দলে রয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাকস, মাস্টারকার্ড ও ব্যাংক অব আমেরিকার মতো অন্য মার্কিন কোম্পানিগুলোও তাদের পথ অনুসরণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জেপি মরগানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেমি ডিমন ও ফোর্ডের চেয়ারম্যান বিল ফোর্ড জানিয়েছেন, তারা এ বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। জেপি মরগানের মুখপাত্র বলেন, আমরা নিশ্চিত করতে পারি, জেপি সৌদির অনুষ্ঠানে যোগ দেবে না।
আরও যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা সৌদি আরবের এ বিনিয়োগ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের মধ্যে উবারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দারা খসরুশাহিও রয়েছেন। এছাড়া সিএনএন, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনবিসি ও ব্লুমবার্গের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এ সম্মেলন থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মাদ বিন সালমান (এমবিএস) বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দেশটিতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য এ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। ভবিষ্যতে তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো তথা আধুনিক সৌদি আরব বিনির্মাণের লক্ষ্যে বিদেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন দেশটির। সালমানের ভিশন ২০৩০ পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক বিনিয়োগকারীই আগ্রহ দেখিয়েছিল সেখানে বিনিয়োগ করতে। কিন্তু সম্প্রতি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের দূতাবাসে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে দেশটির সরকার তথা যুবরাজ সালমানের সম্পৃক্ততা দিন দিন স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশ, ব্যবসায়ী ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিনিয়োগ সম্মেলন বয়কট করছে।
রিয়াদের এ বিনিয়োগ সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানি ও গণমাধ্যমগুলো অংশ নিয়ে থাকে। আয়োজনটি ক্রমে বিনিয়োগকারীদের কাছে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সংস্কার কার্যক্রম প্রচারণার বড় একটি মাধ্যম হয়ে উঠেছে। কিন্তু গণমাধ্যম ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে এবারের সম্মেলনটি ম্রিয়মাণ হয়ে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, সৌদি আরবের মন্ত্রিসভা ২০১৬ সালের এপ্রিলে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কারের এক প্রস্তাব অনুমোদন করেছে যার মধ্য দিয়ে তেল বিক্রির ওপর দেশটির নির্ভরশীলতার অবসান ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। দেশটির মোট রাজস্ব আয়ের ৭০ শতাংশ আসে জ্বালানি তেল থেকে। ভিশন-২০৩০ শীর্ষক এ পরিকল্পনা সম্পর্কে যুবরাজ সালমান বলেন, ২০২০ সালের মধ্যে তার দেশের তেলের ওপর নির্ভরশীলতার অবসান ঘটবে। এ সংস্কার পরিকল্পনায় যেসব বিষয় রয়েছে : দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি আরামকোর ৫ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করা হবে, যার মূল্য ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এ বিক্রি থেকে যে তহবিল গঠিত হবে তার আকার দুই ট্রিলিয়ন ডলার। নতুন ভিসা প্রথা চালু করা হবে, যার মধ্য দিয়ে মুসলমান এবং আরবরা সৌদি আরবে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করতে পারবেন। খনি এবং সমরাস্ত্র প্রস্তুত খাতে বিনিয়োগ করা হবে। কাজের ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো হবে।