মুঈদ রহমান : বিকল্পধারা রাজনৈতিক দল হিসেবে এদেশের রাজনীতিতে তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদিও দলটির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আমাদের ভোটারদের কাছে এটি একটি ‘ক্ষুদ্র দল’ হিসেবেই পরিচিত।
খবরে শুনলাম, সে দলের সভাপতি বি চৌধুরী, মাহী বি চৌধুরী এবং মান্নান সাহেবকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ তিনজনের বাইরে দলে যে কোনো নেতা আছেন, তা অনেকেরই কম জানা। খবরটা শুনে একটি গল্পের কথা মনে হল। কোনো এক শহরে নাকি মাত্র দুটি মোটরগাড়ি ছিল। গাড়ি দুটিকে কেউ ধ্বংস করেনি, একটি সরু রাস্তায় মুখোমুখি সংঘর্ষে দুটি গাড়িই চিৎপটাং!
অনেক কারণেই দলের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়। মতাদর্শের বিরোধ, নেতৃত্বের বিরোধ, রাজনৈতিক কৌশলগত বিরোধ এবং সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেও বিরোধ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘কাগমারী’ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতবিরোধ তৈরি হয়। ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে বাম ধারার মানুষের সঙ্গে তৈরি করেন ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ)।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অবস্থান প্রশ্নে বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির পরিষ্কার দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালে রংপুরে পার্টির সম্মেলনে এর প্রভাব লক্ষ করা যায়। মওলানা আবদুল হামিদ সমাজতান্ত্রিক চীনের পক্ষ নিয়ে ন্যাপ (ভাসানী) তৈরি করলেন আর সোভিয়েত রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে খান আবদুল ওয়ালী খান সভাপতি হলেন ন্যাপের (ওয়ালী)। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ পূর্ব পাকিস্তান অংশের সভাপতি থাকায় আমরা ন্যাপ (মোজাফ্ফর) হিসেবেই দলটিকে চিনতাম।
১৯৭৪ সালের নভেম্বরে দলের তরুণ নেতা কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে সমাজকল্যাণমন্ত্রী) গঠন করলেন ‘ইউনাইটেড পিপলস পার্টি’ (ইউপিপি)। দলের এহেন বিশৃঙ্খলার ভেতর দিয়ে ১৯৭৪ সালে মওলানা ভাসানী দলের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন। তারপর থেকে আজতক শোনা যায় ন্যাপ কমপক্ষে ১৩টি ভাগে ভাগ হয়েছে। সবগুলোর খবর জানি না, তবে আজকের কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একটি অংশের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, সভাপতি ছিলেন পঙ্কজ ভট্টাচার্য- দলের নাম ন্যাপ (পঙ্কজ-মতিয়া)। আবু নাসের খান ভাসানীও একটি অংশের সভাপতি ছিলেন। আজকাল আর ন্যাপের খুব একটা খবর লক্ষ করছি না।
১৯৭২ সালে সমাজতন্ত্রের স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগকে ‘বুর্জোয়া’ আখ্যা দিয়ে একদল তরুণ নেতা তৈরি করেন ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ)। মেজর (অব.) জলিল, আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু, কাজী আরেফ আহমেদ প্রমুখ এ দলের নেতৃত্ব দেন। এদের মধ্যে হাসানুল হক ইনু বর্তমান আওয়ামী সরকারের তথ্যমন্ত্রী। সে সময়ে জাসদ আওয়ামী লীগের ঘুম হারাম করে দিয়েছিল। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক করে ফেলেছিল এ দলটি।
১৯৮০’র শুরুতেই রণনীতি এবং রণকৌশল নিয়ে দলটিতে বিরোধ বাধে। ‘বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল’ (বাসদ) নামে কমরেড খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত হয় বাসদ। বছর তিনেক বাদে মাহবুবুল হক এবং মাহমুদুর রহমান মান্না দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করেন বাসদ (মাহবুব-মান্না) অপর দলের নাম বাসদ (খালেকুজ্জামান)।
মাহবুব সাহেব কানাডায় বসবাসরত অবস্থায় মারা যান আর মাহমুদুর রহমান মান্না ১২ বছর আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘর-সংসার করে বর্তমানে ‘নাগরিক ঐক্যের প্রধান। বাসদে (খালেকুজ্জামান) বছর-দুই আগে কমরেড শিবদাস ঘোষের অথোরিটির প্রশ্নে কমরেড মুবিনুল হায়দারের নেতৃত্বে নতুন দল তৈরি হয় বাসদ (মার্ক্সবাদী)।
ওদিকে জাসদ আবার ভেঙে জাসদ (রব) এবং জাসদ (ইনু)-তে রূপ নেয়। হাসানুল হক ইনু পরবর্তী সময়ে নৌকা মার্কা নিয়ে সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। সঙ্গে ছিলেন মঈনুদ্দিন খান বাদল। দু’দিন বাদে বনিবনা না হওয়ায় বাদল নতুন দল খুলে বসলেন।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগে ভাঙন ধরান মিজানুর রহমান চৌধুরী। ‘নিন্দুকেরা’ বলে থাকেন ‘ওষুধে’র ব্যবসায় কিছু সরকারি সুবিধা পাওয়ার জন্যই নাকি আওয়ামী লীগ (মিজান) তৈরি করেন তিনি। সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজীরও একটি আওয়ামী লীগ ছিল- আওয়ামী লীগ (ফরিদ গাজী)। এখন দল দুটির অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না।
আওয়ামী লীগে বড় আকারের ভাঙন ধরে আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে এসে মহিউদ্দিন আহমদ এবং আবদুর রাজ্জাক তৈরি করেন ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। আবদুর রাজ্জাকের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অনেক।
ছাত্র সংগঠনের একটি বড় অংশ বাকশালের সমর্থনে চলে যায়। কিন্তু সমস্যা ছিল দলটির রাজনৈতিক কৌশলের। যদি সমাজতান্ত্রিক ধারায় দলটি এগোতো তাহলে কথা ছিল। এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আপনি যত বড় চিৎকারই দেন না কেন, তা শেখ হাসিনার চিৎকারকে মাড়িয়ে জনগণের কানে পৌঁছাবে না। আমরা অনেকেই তখন ভেবেছিলাম যে, এ দলটি আবার আওয়ামী লীগে ফিরে যেতে বাধ্য এবং পরে তাই হয়েছে। তখন আওয়ামী লীগের ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকে এসে প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করেন ‘গণফোরাম’।
বিএনপিতে প্রথম ভাঙন ধরান ওবায়দুর রহমান। দলের নাম হিসেবে পরিচিতি পায় বিএনপি (ওবায়েদ)। সময়ে সময়ে আরও কিছু নেতা বিএনপি থেকে বেরিয়ে নতুন দল করেন।
কর্নেল অলি আহমদ বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে দল করেন ‘লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি’ (এলডিপি)। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একসময় ‘কট্টর বিএনপি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু শেষতক বিএনপি থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন ‘তৃণমূল বিএনপি’। ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি রাষ্ট্রপতি বানিয়েছিল। কিন্তু তাকেও বিএনপি ধরে রাখতে পারেনি। তার নেতৃত্বে তৈরি হল ‘বিকল্পধারা’।
কমরেড ফরহাদ মারা যাওয়ার পর নব্বইয়ের শুরুতেই বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) দু’ভাগ হয়ে যায়। সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও নূরুল ইসলাম নাহিদ (বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী)-এর সঙ্গে মঞ্জুরুল আহসান খান এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের বনিবনা হল না। এখন অবশ্য সিপিবি বলতে মানুষ মঞ্জুরুল আহসান খান এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকেই বুঝে থাকেন।
ভাঙন থেকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিও রেহাই পায়নি। নাজিউর রহমান মঞ্জু দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৈরি করলেন ‘বাংলাদেশের জাতীয় পার্টি’ (বিজেপি)। অপরদিকে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু (বর্তমানে পানিসম্পদমন্ত্রী) গঠন করলেন ‘জাতীয় পার্টি’ (মঞ্জু)।
এ সাতকাহনে দেখা যায়, ভাঙনের পর বাম দলগুলো বছরওয়ারি যতটা দলীয় কাজ করে, বুর্জোয়া দলগুলোর ক্ষেত্রে তা দৃশ্যমান নয়। কিন্তু নির্বাচন এলে সব দল সরব হয়ে উঠে। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, বাম দলগুলোর ভাঙার ক্ষেত্রে কিছু তাত্ত্বিক বিতর্কের অবতারণা করা হয়ে থাকে, যা বুর্জোয়া দলগুলোর ক্ষেত্রে হয় না। মূল দল ভেঙে নতুন দল করে জনগণের সমর্থন আদায় করার বেলায় একমাত্র ভাসানীই ব্যতিক্রম, বাদবাকিরা জনমননে তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
মুঈদ রহমান : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়