এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দেশের ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় তিন হাজার শিক্ষক ছুটিতে আছেন, যা মোট শিক্ষকের ২১ শতাংশের বেশি। ছুটিতে যাওয়া শিক্ষকদের বড় একটি অংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। অনেকে ছুটি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে গেছেন, যাদের কেউ কেউ ছুটি শেষে আর দেশে ফিরছেন না।
অননুমোদিত ছুটিতে থাকা এসব শিক্ষকের অনেকের খোঁজও নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। ছুটির তালিকায় প্রেষণ ও লিয়েনে অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা শিক্ষকও আছেন। এ ছাড়া শিক্ষকদের বড় একটি অংশ ছুটি না নিয়েই বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন। কোনো রকমে ক্লাসে হাজিরা দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিতে বা পরামর্শ দিতে কিংবা শেয়ার ব্যবসায় যাওয়া শিক্ষকও অনেক আছেন। শিক্ষকদের এমন মানসিকতায় বিঘ্নিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উল্লিখিত প্রায় ৩ হাজার শিক্ষক অন্তত পাঁচ ধরনের ছুটিতে আছেন। এর মধ্যে ২১০১ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে, প্রেষণ ও লিয়েনে ৮৪ জন, বিনা বেতনে ৫৮ জন, অননুমোদিত ছুটিতে ১৭ জন। এ ছাড়া খণ্ডকালীন চাকরি বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অন্যত্র আছেন ৬৮০ জন।
ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, জাতীয় প্রয়োজন বা সরকারি কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ বা সেবা নেয়ার প্রয়োজন আছে। সিনিয়র শিক্ষকদের একটি অংশ এমন সেবা দিয়ে থাকেন। ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৪ হাজার শিক্ষকের মধ্যে এমন ৮৪ জন আছেন। সেটা উদ্বেগের বিষয় নয়। সমস্যা হয় যখন কোনো শিক্ষক শিক্ষাছুটি নিয়ে বিদেশে গিয়ে লেখাপড়া শেষে দেশে না ফেরেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যখন কাউকে ছুটি দেয়, তখন প্রত্যাশা থাকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা শেষে ফিরে দেশ-জাতিকে সেবা দেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী সেভাবে চুক্তিও থাকে। কিন্তু অনেকে গিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। উন্নত জীবনের লোভে দেশকে ভুলে যান। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ ৫ বছরে নেয়া বেতন ও পাওনা ফেরত পর্যন্ত দেন না। অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাওনাদি পরিশোধ করেন। কিন্তু পাওনা পরিশোধই শেষকথা নয়। ওই শিক্ষক বেআইনি ও অনৈতিক কাজ করেছেন। এ ধরনের শিক্ষকদের শাস্তি হওয়া উচিত।
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ হাজার ২৬৮ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৯৪ জনই আছেন শিক্ষাছুটিতে। প্রেষণ ও লিয়েনে আছেন ১৪ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে ১৯ জন, অননুমোদিত ছুটিতে ১ জন এবং খণ্ডকালীন ও চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে আছেন ৩১৮ জন। এরপরই অবস্থান বুয়েটের। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫১ জনের মধ্যে ১৭৮ জন শিক্ষাছুটিতে আছেন। এ ছাড়া প্রেষণ ও লিয়েনে ৩ জন, বিনা বেতনে ছুটিতে ১ জন এবং খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বাইরে চাকরি করছেন ৯৫ জন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে। সে জন্য আমরা শিক্ষাছুটি উৎসাহিত করি। এ ছাড়া জাতীয় প্রয়োজনে অনেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় পদে যোগ দেন। সেটারও প্রয়োজন আছে। কিন্তু যে বা যারা ছুটি নিয়ে তার অপব্যবহার করেন, তারা অনৈতিক কাজ করেন। সে ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত কঠোর। অননুমোদিত ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের আমরা কয়েক দফায় চাকরিচ্যুত করেছি। খণ্ডকালীন বা চুক্তিভিত্তিক চাকরির জন্য আমরা নীতিমালা করেছি। এ ক্ষেত্রে নবীন শিক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কেননা, চাকরিতে যোগদানের পরের সময়টা নিজেকে গড়া এবং গবেষণার মাধ্যমে দেশকে উপকৃত করাই তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, ছুটি শেষে যোগদান না করা বা বিদেশে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে আমরা শিক্ষাছুটি দিয়ে থাকি। বিশেষ করে যারা উত্তর আমেরিকায় পিএইচডি করতে যান তাদের অনেক সময় চার বছরের বেশি ছুটি লাগে। সুপারভাইজারের সুপারিশে সেটা মঞ্জুর করা হয়।
ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কর্তব্যরত শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিতির ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) এগিয়ে। জবিতে মোট শিক্ষকের ২১ এবং বাকৃতিতে ২০ শতাংশই শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে। জবির মোট ৬২৬ জন শিক্ষকের মধ্যে ১১৯ জন শিক্ষাছুটিতে। ১৩ জন বিনা বেতনে এবং ১ জন প্রেষণে আছেন। বাকৃবিতে মোট ৫৯৯ জনের মধ্যে ১১৯ জনই বিভিন্ন ধরনের ছুটিতে আছেন। নতুন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও করুণ। ১৭৩ জনের মধ্যে ২৮ জন আছেন শিক্ষাছুটিতে।
এ ব্যাপারে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি (বর্তমানে সাবেক) অধ্যাপক ড. হারুনর রশিদ বলেন, একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পথযাত্রা শূন্য থেকে শুরু করা অনেক কঠিন। সেখানে সিনিয়র শিক্ষক থাকেন না। নতুনরাই পাঠদান করেন। সেই বিবেচনায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে যদি শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানে ফেরেন সেটা ইতিবাচক। তবে প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপকদের কিছুতেই খণ্ডকালীন চাকরির অনুমতি দেয়া উচিত নয়। কেননা, এ সময় লেখাপড়া আর গবেষণাই তাদের ব্রত হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, বড় শহরের বাইরে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো রেজাল্টধারী শিক্ষক পাওয়া আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যা সমাধানে আমি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছিলাম।
চারটি প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত প্রার্থীদের ৫টি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর সুফলও পেয়েছিলাম। তিনি মনে করেন, বিদ্যমান নিয়মে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক নিয়োগ খুবই কঠিন। এ ক্ষেত্রে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ শিক্ষকদের স্বল্পসময়ের জন্য বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এদিকে ইউজিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা খুবই করুণ।
অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পদে ব্যাপক স্বল্পতা আছে। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের স্থায়ী পদও তেমন সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে উচ্চশিক্ষা দারুণভাবে বিঘিœত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে আছে, অপেক্ষাকৃত কম প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে আকর্ষণীয় সুবিধা দিয়ে অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপকদের প্রেষণে পাঠানো। ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উন্নত চিকিৎসাসেবা ও মেডিকেল সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং ছেলেমেয়েদের মানসম্মত শিক্ষার জন্য স্কুল-কলেজ স্থাপন। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্তদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের লিয়েনে পাঠাতে নীতিমালা ও বিশেষ উদ্যোগ দরকার।