এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : সংলাপে অসন্তুষ্ট ঐক্যফ্রন্ট দাবি আদায়ের বিষয়টি মাঠেই ফয়সালা করতে চায়। এ লক্ষ্যে আগামী ৬ নভেম্বর রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এই জোট জনসভা করতে যাচ্ছে। সেখান থেকেই দাবি আদায়ে নতুন কর্মসূচি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নেতারা।
আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে চাপে রাখার পাশাপাশি কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনার পথও খোলা রাখবেন তারা।
নতুন এ জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সংলাপের পর শুক্রবার রাতে ড. কামাল হোসেনের বাসায় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বৈঠক করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপের বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়।
এতে বলা হয়, গণভবনের আলোচনা থেকে তারা তেমন কিছুই পাননি। পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। ফের সংলাপে বসলেও তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় তারা মনে করেন আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই। মাঠে নেমেই দাবি আদায় করতে হবে। কাজেই মাঠে নামার ওপরই তারা গুরুত্বারোপ করেন।
এছাড়া পরবর্তী করণীয় নিয়েও আলোচনা করেন। এদিকে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলটির শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেন। আজ শনিবার সন্ধ্যায় ফের ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় বৈঠকে বসবেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।
এতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভা সফল করার পাশাপাশি আগামী ৯ নভেম্বর রাজশাহীতে জনসভা আয়োজনের প্রস্তুতি নিয়েও আলোচনা হবে। এর বাইরে আর কি কি কর্মসূচি দেয়া যায়- তা চূড়ান্ত হতে পারে।
সভা-সমাবেশ ছাড়াও নতুন করে লংমার্চ-রোডমার্চ, মানববন্ধন, গণঅনশন, গণসংযোগ প্রভৃতি কর্মসূচি দেয়ার কথা ভাবছেন তারা। শুক্রবার গণফোরাম আয়োজিত জেলহত্যা দিবসের আলোচনায় দলটির নেতারা বলেছেন, মাঠেই তারা দাবি আদায়ের বিষয় ফয়সালা করবেন।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে বসার মধ্য দিয়ে আলোচনার দ্বার উন্মোচন হলেও আমাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমরা আমাদের কথা বলেছি। তিনি শুনেছেন। অনেক কথা বলেছেন। দু-একটি বিষয় ছাড়া দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আলোচনার পথ খোলা রাখব। পাশাপাশি দাবি আদায়ে রাজপথে নামব, জনগণের ঐক্য গড়ে তুলতে কাজ করব।’
বিএনপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি এবং নাগরিক ঐক্যকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন গত ১৩ অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেন। জোট গঠনের দিন তারা সাত দফা দাবি এবং ১১ লক্ষ ঘোষণা করেন।
এসব দাবির মধ্যে আছে- সংসদ ভেঙে, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে। অন্যথায় নির্বাচনে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত হবে না বলে তারা দাবি করেন। দাবিগুলো আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে বলে নেতারা জানিয়েছেন।
তারা বলেন, এর সঙ্গে যোগ হবে নতুন কর্মসূচি। দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করা হবে বলে তারা উল্লেখ করেন।
জোট গঠনের পর সংলাপ চেয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে গত মাসের শেষদিকে চিঠি দেন ড. কামাল হোসেন। এতে সাড়া দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে দু’পক্ষের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে চলে আলোচনা।
কিন্তু সেখান থেকে তেমন কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি। গণভবন থেকে বেরিয়ে ওই রাতেই তারা ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় বৈঠক করেন। এ সময় দাবি আদায়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শুক্রবার বলেন, ‘আন্দোলনই এখন দাবি আদায়ে আমাদের একমাত্র ভরসা। আন্দোলন ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।’
জানতে চাইলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের কিছু দাবি সরকার মেনে নিয়েছে। বাকি দাবিও তাদের মানতে হবে। দাবি আদায়ে আমরা এবার চূড়ান্ত আন্দোলনে নামব।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে তা মানব না। সরকার চাইলে যা খুশি করবে- তা হতে দেয়া হবে না।’
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা আশাহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদ না ভাঙার বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা দেন। যে সরকার আছে সেই সরকারই বহাল থাকবে- এটাও প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে বলেছেন। এ অবস্থায় ফ্রন্ট নেতারা ভাবছেন আন্দোলনই এখন একমাত্র ভরসা। সেভাবেই তারা তৈরি হচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সংসদ এবং সরকার বহাল রেখে নির্বাচন হলে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে আমাদের কি লাভ হবে? ফলাফল তো আগে থেকেই তৈরি করা থাকবে।’ আবদুল মালেক রতন বলেন, ‘দাবি আদায় করতে হলে এখন আন্দোলনে নামতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র জানায়, সংলাপে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্যের পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সাত দফা উত্থাপন করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর এ নিয়ে একে একে আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, ড. মঈন খান, জেএসডির সভাপতি আসম আবদুর রব, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। প্রত্যেকেই সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সায় দেন।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যাপারটি আদালতের বিষয়। এখানে তার হাত নেই। সংলাপে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার দাবিও জানায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। প্রধানমন্ত্রী এ প্রস্তাবেও সায় দেননি।
ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জানান, সংলাপে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাইরে ১৪ দলীয় জোটের শরিক তিন দলের তিন নেতার বক্তব্য ছিল বেশ আক্রমণাত্মক। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় সারা দেশে খুনখারাবি নিয়ে কথা বলেছেন।
উচ্চস্বরে বক্তব্য দিয়েছেন জাসদের অপর অংশের কার্যনির্বাহী সভাপতি মাঈন উদ্দীন খান বাদল। কথা বলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননও।
তিনি ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আপনি এখন বিএনপিকে উদ্ধারে নেমেছেন। এটা দুঃখজনক।’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না সংলাপে দুটি বিষয় উত্থাপন করেন। একটি হচ্ছে, যে সংলাপ শুরু হয়েছে, পরিস্থিতি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তা চালু রাখা। দ্বিতীয়ত, সংলাপ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করা। দুটোর একটিও আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ।
এ অবস্থায় সংলাপ শেষে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন। অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু তার কথায় তারা কোনো বিশেষ সমাধান পাননি।
জোটের আরেক শীর্ষ নেতা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা এই সংলাপে সন্তুষ্ট নই।’ এর জবাবে অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার বলেছেন, ‘আরও আলোচনার জন্য দুয়ার খোলা রয়েছে।’
কিন্তু শাসক দলের নেতাদের কথায় আর আস্থা রাখতে নারাজ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। তারা আলোচনার পথ খোলা রাখার পাশাপাশি দাবি আদায়ে বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে চান।