সুখেন্দু সেন : প্রান্তিক জেলা সুনামগঞ্জের উত্তর সীমান্তজুড়ে জল-পাহাড়ের এমনই সঘন মিতালি। হিজল মায়ার জল ভর ভর টাঙ্গুয়ার হাওর, অদূরে মেঘ-পাহাড়ের হাতছানি। বুকে বাজে জল-হাওরের গান, চোখে লাগে বন-পাহাড়ের টান।
প্রান্তিক জেলা সুনামগঞ্জের উত্তর সীমান্তজুড়ে জল-পাহাড়ের এমনই সঘন মিতালি। হিজল মায়ার জল ভর ভর টাঙ্গুয়ার হাওর, অদূরে মেঘ-পাহাড়ের হাতছানি। পাদদেশে টেকেরঘাট শহীদ সিরাজ লেকের গভীর জলে মাথা নুয়ে রয় আকাশের নীল। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে বড়গোপ টিলা (বারেকের টিলা) থেকে সামনে কিছুটা উদাস শূন্যতা রেখে ভারতীয় সীমান্তে খাসিয়া পর্বত শ্রেণি। চোখ টেনে নিতে নিতে পাহাড় বেয়ে নামে দূর দেখা ঝরনা। নিচে ছড়ানো স্বর্ণরেণুর মতো বালুকাভূমি দু’পাশে রেখে ঝিরঝির বয়ে চলা যাদুকাটা নদী। ঘাড় ফিরিয়ে কিছুদূর এগোলেই শিমুল বাগানের দিগন্তছোঁয়া আবির হোলির মুগ্ধ মোহ।
প্রকৃতির রূপময়তা শুধু নয়; ঐতিহ্যের শিখর, ইতিহাসের গৌরব, আধ্যাত্মিকতার স্পর্শ, স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি একাকার হয়ে মিশে রয় জল-পাহাড়ের এই যুগলবন্দিতে। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির আদি গৌরবের চিহ্নসূত্র অঙ্কিত হয়ে আছে যাদুকাটার তীরে তীরে।
খাসিয়া পাহাড়ের রহস্যময় গিরি খাত বেয়ে সমতলের মায়াবী আকর্ষণে নেমে আসা স্বচ্ছতোয়া ধারা একদা রেণুকা নামে প্রবাহিত ছিল প্রাচীন লাউড় রাজ্যের বুক চিরে। বৈষ্ণব অবতার শ্রী গৌরাঙ্গের অন্যতম পার্ষদ অদ্বৈতাচার্য, বাংলা মহাভারতের আদিকবি সঞ্জয়, কুবেরাচার্য, দিব্যসিংহ পণ্ডিতরা এ রাজ্যের জন্মধন্য পুরুষ। হযরত শাহজালালের সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সুফিসাধক শাহ্ আরেফিন শেষ আস্তানা গেড়েছিলেন লাউড় রাজ্যের সীমান্তে। স্রোতস্বিনী নদীর মতোই বাংলা কাব্যের আদি ধারা প্রাকচৈতন্য যুগ ছাড়িয়ে রেণুকার তীর ছেড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সুরমা, কালনী, রক্তি, কংস, সোমেশ্বরীর তীরে তীরে। গড়ে উঠেছে ভাটি বাংলার প্রাণময় সংস্কৃতি। রাধারমণ, হাছন রাজা, দুর্ব্বিন শাহ্, শাহ্ আবদুল করিমের হৃদ উৎসারিত, কণ্ঠনিঃসৃত বাণী ও সুরঝংকার আজ অনুরণিত হয় বিশ্বসংস্কৃতির অঙ্গনেও।
একদা সমৃদ্ধ লাউড় রাজ্যের আজ আর কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রাচীন সেই রেণুকা নদী সময়ের বাঁকে নাম বদলে, কিছুটা গতিপথ বদলে যাদুকাটা নামে আজও বহমান। আদি প্রকৃতি আর গৌরবের উত্তরাধিকার নিয়ে লাউড় রাজ্যের রাজধানী তাহিরপুর উপজেলার লাউড়ের গড়ে শুধু এক ক্ষয়িষ্ণু, ম্রিয়মাণ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে কালের খাঁচায় বন্দি।
আদি লাউড়ের সঙ্গে কোনো বন্ধন নেই; নন এ জেলার বাসিন্দা। তবুও এখানকার জলডাঙ্গার ঐতিহ্য সংস্কৃতির মুগ্ধতায় আবিষ্ট সত্য সুন্দরের নিরঙ্কুশ অনুরাগী জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম জেলার গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়েও ছুটে চলেন ঐতিহ্য অনুসন্ধানী নিষ্ঠাবান পরিব্রাজকের মতো অপরূপা নিসর্গ আর ঐতিহ্য-গৌরবের পরিচয়কে উন্মোচিত করার শ্রমনিষ্ঠ প্রয়াসে।
লোকচক্ষুর অন্তরালে ঝোপঝাড়, জঙ্গল আর বনলতায় আচ্ছাদিত, অনাদৃত পড়ে থাকা শ্রীহীন কিছু প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝার উপায় নেই, সুপ্রাচীন সুখ্যাতির এক সমৃদ্ধ রাজ্যের রাজধানী ছিল এখানে। বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত শেষ চিহ্নগুলো যেখানে চোখে পড়ে তার অবস্থান তাহিরপুর উপজেলার হলহলিয়া গ্রামে। প্রচলিত নাম হাওলি। হাভেলির পরিবর্তিত রূপ। স্থাপনাগুলো লাউড় রাজত্বের শেষ সময়কালে নির্মিত দুর্গবিশেষ। একদা কারুকার্যময় সিংহদরজা, কয়েকটি ফটক, সুরক্ষিত বন্দিশালা, সমৃদ্ধ হাতিশাল-ঘোড়াশাল, সেনা আবাসন এবং নিরাপত্তা প্রাচীরে ঘেরা ছিল বলে অনুমান করা হয়। আজ যদিও এর ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র দৃষ্টিগোচর, তবুও ঝোপঝাড়ের আচ্ছাদন সরিয়ে ফটকে চোখ রাখলে কী এক রহস্যময়তা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে! কালের ক্ষয়িষ্ণু অক্ষরে লেখা ধূলিমাখা পৃষ্ঠাগুলো খুলে যেতে থাকে গৌরবের আপন মহিমায়। বিত্ত, বৈভব, জৌলুস, সংঘাত, বিরোধ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, জয় পরাজয়ের কথকথা নিয়ে সহস্রাব্দের ইতিহাস যেন হাহাকার করে ওঠে। সম্রাট আকবরের আমলে মুঘল বশ্যতায় রাজ্যের স্বাধীন মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়। বহিঃশত্রুর আক্রমণ, স্বজন বিরোধ, অন্তর্দ্বন্দ্বে শক্তি ক্ষয় হতে হতে ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে সম্মিলিত খাসিয়া আক্রমণে রাজধানী একেবারেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ক্ষয়িষুষ্ণ রাজ্যের রাজধানী বানিয়াচংয়ে স্থানান্তর করা হয়।
আজকের দিনটিতে ইতিহাসের খনন না হলেও নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা হলো ভগ্নাবশেষগুলো। জেলা প্রশাসক স্বয়ং লাল নিশান গেড়ে প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উদ্ধার কার্যক্রমের প্রতীকী সূচনা করলেন। দুই কিলোমিটার দূরে ব্রাহ্মণগাঁওয়ে মাধবেন্দ্রপুরীর বাস্তুভিটাটিও চিহ্নিত করা হলো। নেওয়া হবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা। সংযুক্ত করা হবে টেকেরঘাট স্বাধীনতা উপত্যকা, টাঙ্গুয়ার হাওর, শিমুলবাগান, শ্রী অদ্বৈত মন্দির, শাহ্ আরেফিন পর্যটন স্পটের সঙ্গে। যাদুকাটা নদীর ওপর সিলেট বিভাগের দীর্ঘতম এবং দৃষ্টিনন্দন শাহ্ আরেফিন-শ্রী অদ্বৈত মৈত্রী সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। মাহরাম নদীতে প্রস্তাবিত উড়াল সড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) বাস্তবায়িত হলে এ অঞ্চলটি হয়ে উঠবে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন প্যাকেজ। বর্ষা ও শুস্ক দুই মৌসুমেই ভিন্নতর মোহনীয় রূপের ডালি মেলে ধরে প্রকৃতি। শীতে টাঙ্গুয়ার বিলে পরিযায়ী পাখির কলরব, কুয়াশা ভাঙা রোদে কাছে আসা দূরের পাহাড়। হেমন্তে হাওরজুড়ে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের দোলা। বসন্তে শিমুল বাগানে ফোটা ফুলের আবির রাঙা ঢেউ।
শ্রাবণের রোদবৃষ্টির একটি দিন কাটল শুধু ঐতিহ্য অনুসন্ধানে নয়- জলের গানে মন ভরিয়ে, বন-পাহাড়ের মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে যেতে ফেরা হলো সবুজ স্নানে সিক্ত হয়ে।
যেভাবে যাবেন : বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার দিবা-রাত্রির অনেক এসি, নন-এসি কোচ ঢাকা-সুনামগঞ্জ যাতায়াত করে। সুনামগঞ্জ থেকে সিএনজি, লেগুনা, কার, মোটরসাইকেলে তাহিরপুর, টেকেরঘাট যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে তাহিরপুর থেকে ভাড়া নৌকা, স্পিডবোট পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জ থেকে সরাসরি স্থলপথে লাউড়ের গড়, শ্রী অদ্বৈত মন্দির, শাহ আরেফিন যাওয়া যায়। যাদুকাটা নদী পেরিয়ে শিমুল বাগান, বড়গোপ টিলা, টেকেরঘাট স্বাধীনতা উপত্যকা দেখে আসা যায়। বর্ষায় নৌকায় ঢেউভরা হাওর পাড়ি দেওয়ার রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে সব স্পটেই যাওয়া যেতে পারে।