এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : বিদ্যমান ব্যবস্থায় মাত্র ৬৬ জন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরতে রাজী। বাকীরা এখনও সিদ্ধান্তহীনতায়। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, প্রত্যাবাসনের প্রথম ব্যাচে ২২১৬ জন রোহিঙ্গাকে ফেরানোর একটি তালিকা হয়েছে। যা মিয়ানমার সরকারকে জানানোও হয়েছে। এদের মধ্যে ৬৬ জন আগে থেকেই ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। রাখাইনের বাসিন্দা হিসাবে প্রমাণের জন্য তাদের হাতে শক্ত ডকুমেন্ট থাকায় ভেরিফিকেশন ছাড়াই মিয়ানমার সরকার তাদের গ্রহণে ক্লিয়ারেন্স বা অনাপত্তি দিয়েছে। তবে প্রথম ব্যাচে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত তালিকায় পাঁচ শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও রয়েছেন।
যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে বর্তমানে কক্সবাজারে অস্থায়ী আশ্রয়ে রয়েছেন।
তাদের গ্রহণে মিয়ানমার শুরু থেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হিন্দুরাও ফিরতে চান। কিন্তু বাংলাদেশ হিন্দু-মুসলিম কোনো পার্থক্য না করে বাস্তুচ্যুত হিসাবে একসঙ্গে তাদের ফেরাতে চায়। প্রথম ব্যাচেই তাদের ফেরৎ পাঠানো হবে। বাংলাদেশ এতদিন রাখাইনে বসবাসের অনুকূল পরিবেশ তথা নিরাপত্তার গ্যারান্টি পাবার অপেক্ষায় ছিল। সূত্র মতে, মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গেছে এমন রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা ফিরতে দ্বিধায় রয়েছেন, অবস্থা বুঝে, রাখাইনে অনেকে ফিরে যাওয়ার পর ‘সব ঠিক আছে’ এমন ধারণা পাওয়ার পর ফিরতে চায়- তাদের মাঝে কনফিডেন্স বা আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত জাতিসংঘের শরনার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএএইচসিআর এর কর্মকর্তারা। সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল মানজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, আমরা এখনই প্রত্যাবাসনের প্রথম ব্যাচে কতজন যাচ্ছেন? সেই সংখ্যা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ আমরা একাধিক ‘সংখ্যা’ নিয়ে কাজ করছি।
কিছু সমস্যাও আছে। প্রথম ব্যাচে কতজন ফিরছেন? তা বিভিন্ন সূত্রে এরইমধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সরকারী ওই কর্মকর্তা বলেন, দেখি না, শেষ পর্যন্ত কতজনকে পাঠানো যায়। জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্যরা গত ৩০শে অক্টোবর ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। পরদিন তারা কক্সবাজারে গিয়ে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরজমিনে দেখেছেন এবং তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, শেষ পর্যন্ত যারা রাজি হবেন তারাই প্রথম ব্যাচে যাবেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৮ হাজার ৩২ জনের যে তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল সেটির ভেরিফিকেশনে প্রায় ৮ মাস সময় নিয়েছে নেপি’ড। তারা এ পর্যন্ত ১৯ দফায় সাড়ে ৬ হাজার জনকে গ্রহণে অনাপত্তি দিয়েছে। বাকিদের বিষয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। যাদের গ্রহণে মিয়ানমারের সম্মতি রয়েছে তাদের দ্রুত ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশ। ঢাকায় অনুষ্ঠিত গত ৩০শে অক্টোবরের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে মধ্য নভেম্বর থেকে প্রত্যাবাসন শুরুর দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে।
ওই বৈঠকের পরপরই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রশ্ন তুলেছে- এরা কি স্বেচ্ছায় ফিরছেন? রাখাইন কি প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত? তড়িঘড়ি করতে গিয়ে জাতিসংঘকে বাইপাস করে রোহিঙ্গাদের ফেরানো হচ্ছে কি-না সেই প্রশ্নও তোলে বিশ্ব সম্প্রদায়। তবে সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক উদ্বেগ হচ্ছে- ফিরে যেতে রাজি রোহিঙ্গারা রাখাইনে কতটা নিরাপত্তায় থাকবেন? মিয়ানমার আদৌ কি তাদের নিরাপত্তা দেবে, নাকি ফের তারা নির্যাতনের শিকার হবেন? বৈশ্বিক এসব উদ্বেগের প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক গতকাল গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানান, বাংলাদেশও ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দিকটি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়ে দেখছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ আমলে নিয়েই প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। প্রত্যাবাসন চুক্তি মতে ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমেই আগামী ১৫ই নভেম্বর প্রথম ব্যাচ পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আমরা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধিকে ডেকেছিলাম। তার সঙ্গে এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। আমরা তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো শুনেছি। এ নিয়ে যে মতানৈক্য সেটি দূরীকরণের চেষ্টা করেছি। মিয়ানমারও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ব্রিফ করছে জানিয়ে সচিব বলেন, দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে প্রত্যাবাসন শুরুর যে ডেটলাইন ঠিক হয়েছে আশা করি ওই দিনে প্রথম ব্যাচকে পাঠানো যাবে।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব ও স্থানীয় প্রশাসনের যারা গেল সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা ফিরে যেতে প্রস্তুত এবং যারা এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় সেই রোহিঙ্গাদের উদ্বেগের কথা শুনেছেন। তারা তাদের নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরার বিষয়ে আশ্বস্ত করে গেছেন। কিন্তু এতে রোহিঙ্গারা কতটা আশ্বস্ত হয়েছে? সেই প্রশ্নে সচিব খোলাসা না করে কেবল বলেন, আমরা সব উদ্বেগই আমলে নিচ্ছি। রোহিঙ্গারাও সরাসরি মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে। তারা তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছে। দেখা যাক কতজন রাজি হয়। আপনারা দেখবেন, দুনিয়াও দেখবে। আমরা তাদের স্বেচ্ছায় ফেরত পাঠাতে চাই। টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য এটা জরুরি। ঢাকার বৈঠকে ভেরিফিকেশনের জন্য বাংলাদেশ ২২ হাজার ৪৩২ জন রোহিঙ্গার দ্বিতীয় প্রত্যাবাসন তালিকা মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর কররা হয়েছে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আশা করি মিয়ানমার সরকার এদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে পরবর্তী প্রস্তুতির জন্য ঢাকাকে বলবে। আমরা সেই অপেক্ষায় রয়েছি।
মিয়ানমার প্রতিনিধি দল যখন কক্সবাজারে সেই দিন সফররত ডেনমার্কের উন্নয়নমন্ত্রী উলা টরনেস এবং ডব্লিউএফপি’র নির্বাহী পরিচালক বিসলে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাক্ষাতে সরকারপ্রধান তাদের জানান, প্রত্যাবাসনের প্রথম ব্যাচে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া ৪৮৫ পরিবারের ২ হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরছেন। উল্লেখ্য, নির্বাচনের আগে প্রত্যাবাসনের জট খুলতে এবং প্রক্রিয়াটি দ্রুততর করতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রীর মধ্যস্থতা এবং তার উপস্থিতিতে বেইজিং ও নিউ ইয়র্কে এ নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে দু’দফা আলোচনা হয়েছে। সামনে তৃতীয় দফায় তারা আলোচনায় বসছেন বলে ঢাকায় চীনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গেল মাসের সফরে জানানো হয়েছে।