মিজান মালিক : সুইজারল্যান্ডের সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকে (এসএনবি) বাংলাদেশিদের অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্ত শুরু করেছে অপরাধ তদন্ত সংস্থা (সিআইডি)। বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তদন্তে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সিআইডিকে চিঠি দেয়। এ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডি অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তে নেমেছে বলে জানা গেছে।
দুদকের চিঠিতে বলা হয়, ২০১৭ সালে ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন উপায়ে কয়েকজন বাংলাদেশি নাগরিক অপ্রদর্শিত ৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রেখেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
চলতি বছরের জুনে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ওভার ভয়েসিং ও ইন ভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করাসহ অবৈধ উপায়ে অর্জিত কালো টাকা তারা পাচার করেছেন। শুধু ২০১৭ সালেই ৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সিআইডির অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শকের কাছে পাঠাতে কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন দুদকের মহাপরিচালক।
সূত্র জানায়, ১৯ সেপ্টেম্বর দুদকের মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) আতিকুর রহমান খানের স্বাক্ষরিত চিঠি পাওয়ার পর সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের ঘটনা তদন্তে সিআইডির এএসপি শারমিন জাহানকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। এ পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে চিঠি দিয়ে পাচারকারীদের বিষয়ে তথ্য চাইবে সিআইডি।
জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা বের করা কঠিন কাজ। তদন্ত কাজে আমরা বিএফআইউর সহায়তা নেব। পাচারের সঙ্গে জড়িতদের নাম-ঠিকানা কেউ জানতে পারলে সিআইডিকে তথ্য দিয়ে তদন্তে সহায়তা করার জন্য তিনি অনুরোধ করেন।
বিএফআইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান যুগান্তরকে বলেন, তদন্তের স্বার্থে সিআইডি বা সংশ্লিষ্ট যে কোনো সংস্থা আমাদের কাছে তথ্য চাইতে পারে। সেই তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা এফআইইউ টু এফআইইউ (ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) চিঠি আদান-প্রদান করি। তবে কি ধরনের তথ্য পাই বা কার বিরুদ্ধে তথ্য পাচ্ছি তদন্তের স্বার্থে আমরা তা প্রকাশ করতে পারি না। এছাড়া যেসব দেশ বা সংস্থা তথ্য দেয় এ বিষয়ে তাদেরও নিষেধাজ্ঞা থাকে।
সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৩ জুলাই পাচার করা অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে সুইস এফআইইউয়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে বিএফআইইউ। বিভিন্ন দেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের আন্তর্জাতিক ফোরাম এগমন্ট গ্র“পের ওয়েব মেইলের মাধ্যমে ওই চিঠি পাঠানো হয়। এগমন্ট গ্র“প হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (এফআইইউ) সমন্বয়ে গঠিত একটি আন্তর্জাতিক ফোরাম।
যারা মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডসহ বিশ্বের ১৫৪টি দেশের এফআইইউ এগমন্ট গ্র“পের সদস্য। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে পাচার করা অর্থ সম্পর্কে তথ্য জানতেও সুইস ব্যাংককে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটে দেয়া চিঠিতে সন্দেহজনক কোনো লেনদেনের তথ্য থাকলেও তা জানাতে অনুরোধ করা হয়। তবে ওই তথ্য বিএফআইইউ হাতে পেয়েছে কিনা তা কেউ বলতে চাননি।
জানা গেছে, অর্থ পাচারের নিরাপদ জায়গা হিসেবে সুইস ব্যাংকের পরিচিতি বিশ্বজুড়ে। আর আইনি প্রক্রিয়া কঠিন থাকায় সুইস ব্যাংক থেকে পাচার করা অর্থ দেশে আনা কঠিন। এর আগে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার চিঠি দেয়া হয়।
সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০১৭ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে ২৭.২৯ ভাগ কমেছে। কিন্তু তার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৯ ভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যমান পরিমাণ যদিও আগের তুলনায় কমেছে কিন্তু এটা এখনও অনেক বড় অংক।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে বাংলাদেশি নাগরিকরা ৪ হাজার ৯১ কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছেন। যা আগের বছরের তুলনায় ১ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা কম। ২০১৫ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বিভিন্ন সংস্থার নজরদারির মধ্যেও অপ্রকাশিত বা কালো টাকার মালিকরা কর অবকাশের (ট্যাক্স হেভেন) জন্য সুইস ব্যাংক থেকে অন্য সব দেশ ও দ্বীপে অর্থ পাচার করতে পারে। শুধু সুইস ব্যাংকই নয়, পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসের মাধ্যমেও দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এ পাচার ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্য সব সংস্থার যৌথ পদক্ষেপ ও কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। দুদক অবশ্য পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৮২ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে।
‘সুইস ব্যাংকে টাকা রাখছেন কোন বাংলাদেশিরা’- শিরোনামে বিবিসি গত বছরের জুনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের রাখা অর্থের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। তবে যারা অর্থ জমা রেখেছেন তাদের পরিচয় কী বাংলাদেশ সরকার চাইলে জানতে পারবে? কারণ সুইজারল্যান্ডের সংবিধান ও ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী সেখানে ব্যাংক গ্রাহকদের গোপনীয়তা কঠোরভাবে রক্ষা করা হয়।
সুইস ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়, গোপনীয়তার অধিকার সুইস আইন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এবং ফেডারেল সংবিধান দ্বারা তা সুরক্ষিত। তবে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে এ সুরক্ষা কাজ করবে না। অর্থাৎ সেখানে গচ্ছিত অর্থ যদি কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে গ্রাহকের পরিচয় প্রকাশে কোনো বাধা নেই।
এতে আরও বলা হয়, অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে সুইস ব্যাংক গ্রাহকদের পরিচয় প্রকাশে বাধ্য। সেই অপরাধ সুইজারল্যান্ডেই হোক আর অন্য কোনো দেশেই হোক। এতে আরও বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সে দেশের ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা।