এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজা হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচন করতে হলে ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে খালেদা জিয়ার সাজা উচ্চ আদালত থেকে বাতিল অথবা স্থগিত হতে হবে।
মনোনয়নপত্র দাখিলের আছে আর মাত্র সাত কার্যদিবস। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এই সময়ের মধ্যে উচ্চ আদালতে খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল অথবা স্থগিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এখনও দুই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় বের হয়নি। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা মনে করেন, সরকার যদি হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে এ সময়ের মধ্যেই আদালতের পক্ষে সাজা স্থগিত করা সম্ভব।
জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আদালত থেকে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তার সাজা স্থগিতের জন্য আছে মাত্র সাত কার্যদিবস। এর মধ্যে দুই মামলায় উচ্চ আদালত থেকে সাজার স্থগিতাদেশ বা বাতিলের আদেশ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ১৯ নভেম্বর। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হলে ওই তারিখের আগে দুই মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা বাতিল অথবা স্থগিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার ১০ বছরের সাজা আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত স্থগিত করলেই চলবে। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া ৭ বছরের সাজা হাইকোর্ট বাতিল অথবা স্থগিত করতে হবে। কিন্তু এ মামলায় বিচারিক আদালতে দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ সত্যায়িত অনুলিপি এখনও প্রকাশিত হয়নি।
মামলা সংশ্লিষ্টরা বলছেন মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্টের দেয়া সাজার বিরুদ্ধে চেম্বার আদালতে যেতে পারবেন। এক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ সত্যায়িত অনুলিপির প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু জিয়া চ্যারিটেবল মামলায় বিচারিক আদালতের সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এর আগে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হতে সময় লেগেছিল ১০ দিন।
২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালত রায় ঘোষণা করেন। সেই রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি এখনও প্রকাশিত হয়নি। কবে প্রকাশিত হবে, তা বলা যাচ্ছে না। যদি এ সপ্তাহে অনুলিপি পাওয়া যায়, তাহলে আপিল ফাইল করতে কমপক্ষে সময় লাগবে আরও তিন দিন। এরপর হাইকোর্টের কার্যতালিকায় মামলাটি আসতে আরও এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খালেদা জিয়ার এক আইনজীবী জানান, বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণ করে, তাহলে ঘোষিত সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়ার প্রার্থী হওয়া অনেকটা কঠিন হতে পারে। এক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে তার প্রার্থিতার বিষয়টি। তিনি বলেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে দেয়া ১০ বছরের সাজা স্থগিত এবং জামিনের জন্য চেম্বার আদালতে যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
রোববার (কাল) হয়তো এ সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এছাড়া এ সপ্তাহে যদি হাইকোর্টের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ সত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশিত হয়, তাহলে সাজা বাতিল এবং স্থগিত চেয়ে নিয়মিত আপিল আবেদন (লিভ টু আপিল) করা হবে। এক্ষেত্রে লিভ টু আপিল গ্রহণ হলেই খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত হয়ে যাবে। যদি পূর্ণাঙ্গ সত্যায়িত অনুলিপি প্রকাশিত না হয়, তাহলে চেম্বার আদালতে যাওয়া ছাড়া আর বিকল্প থাকবে না। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিচারিক আদালতের দেয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিও পেতে হবে এ সপ্তাহে। তবেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আশা করা যায়।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন করতে পারবেন না খালেদা জিয়া। এ অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘কেউ নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে, তাহলে তিনি নির্বাচিত হওয়ার অযোগ্য হবেন।’ তবে উচ্চ আদালতে আপিল আবেদন গৃহীত হলে সাজা পরিবর্তন ও রায় স্থগিত করতে পারেন। সেক্ষেত্রেও নিু আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক শুক্রবার বলেন, খালেদা জিয়া দুই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাচন করতে পারবেন না। এখন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী সময়ের মধ্যে সাজা স্থগিত অথবা বাতিলের বিষয়টি নির্ভর করছে আদালত এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার এম মাহবুব উদ্দিন খোকন শুক্রবার বলেন, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি যায়, তাহলে সাত কার্যদিবসে খালেদা জিয়াকে দেয়া সাজা বাতিল এবং স্থগিতাদেশের সম্ভাবনা আছে। তবে সরকার ও আইন মন্ত্রণালয় যদি কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ না করে।
এর আগে ৩০ অক্টোবর রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, আপিল করে যদি সাজা বাতিল না হয়, তাহলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না খালেদা জিয়া। এখানে দুই রকম ব্যাখ্যা- এক. সাজার কার্যকারিতা স্থগিত করা। দুই. সাজা বাতিল করা। এক্ষেত্রে আমার অভিমত হল, কেউ যদি নির্বাচন করতে চান, সাজা আদালতের মাধ্যমে বাতিল করতে হবে। একই দিন রায়ের পর নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, তিনি (খালেদা জিয়া) নির্বাচন করতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে আদালতের ওপর। উচ্চ আদালত নির্দেশ দিলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন।
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলার মধ্যে দুর্নীতির আছে ৫টি। সেগুলো হল- জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, নাইকো, গ্যাটকো ও বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি দুর্নীতির মামলা। পাঁচটি মামলাই এক-এগারোর সময়ে করা। বাকি ৩১টি ২০১৪ সালের পর করা। মূলত রাষ্ট্রদ্রোহ, হত্যা, ইতিহাস বিকৃতি, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, ভুয়া জন্মদিন পালন ও ঋণখেলাপির অভিযোগে এসব মামলা হয়।
৩০ অক্টোবর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় হাইকোর্ট খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিু আদালতের ৫ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। এর আগের দিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। দুই মামলায় এখনও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি। ৮ ফেব্র“য়ারি বকশীবাজারে কারা অধিদফতরের প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ওইদিন থেকেই কারাগারে আছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।