এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।এখন চলছে শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি।
এখনও চূড়ান্ত হয়নি কোন দল কয়টি আসনে নির্বাচন করবে।জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
আসন ভাগাভাগি নিয়ে ঐক্যফ্রন্টের প্রধান শরিক বিএনপিকে বেশ কিছু বিষয়ে হিসেব মিলাতে হচ্ছে। ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও বিএনপি ২০ দলের (সম্প্রসারিত ২৩ দল) প্রধান শরিক।২০ দলের সঙ্গে বিএনপির গাঁটছাড়া বহু দিনের।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপি ছাড়াও রয়েছে ৪ টি দল। সেগুলো হচ্ছে- গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ।এছাড়া জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে নির্বাচন করবেন বেশ কয়েকজন।
সবমিলিয়ে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে বিএনপিকে ২৭ টি দল (২৩ দলীয় জোট+ ঐক্যফ্রন্টের ৪ দল)নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।দুই জোটের প্রধান শরিক হওয়ায় কয়টি আসন শরিক দলগুলোকে সন্তুষ্ট করা যায় সেটিই প্রধান বিবেচনা বিএনপি নেতাদের।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শতাধিক আসন তারা দাবি করেছে বিএনপির কাছ থেকে।
জোটের শরিক দলগুলো যেসব আসন দাবি করেছে,সেগুলোর কোনো কোনোটিতে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীও রয়েছেন।শুধু তাই নয়,জোটের একাধিক দলের হেভিওয়েট প্রার্থীও আছেন একই আসনে।
এসব নিয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে এক দশক ধরে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে থাকা বিএনপিকে।
আসন ভাগাভাগিতে জোট ও ফ্রন্টের শরিকদের ছাড় দিতে গিয়ে দলের পোড় খাওয়া নেতাদের কিভাবে সামাল দেবেন, এটিই এখন বিএনপির নীতিনির্ধারকদের বড় মাথাব্যথার কারণ।
বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দল শতাধিক আসন দাবি করলেও তারা সর্বোচ্চ ৫০-৬০ আসন ছাড়তে পারেন।তবে জয়ী হওয়ার যোগ্য প্রার্থী হলে ৭০টি আসন ছাড়তেও প্রস্তত বিএনপি।
যেসব আসনে বিএনপির এবং জোটের একাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন, সেখানে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। জোটকে ম্যানেজ করা না গেলে ওইসব আসনে বিএনপির প্রার্থীকে বসিয়ে দেয়া হতে পারে।
যোগ্য প্রার্থী পেলে আসন ছাড়তে প্রস্তুত থাকবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই বড় শরিক দলটি। বিএনপি বলছে, জয়ী হওয়ার মতো প্রার্থী থাকলে শরিক দলগুলোকে আসন ছাড়তে তাদের কোনো আপত্তি নেই।
এদিকে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিজ নিজ এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। কেউ কেউ একাধিক আসনেও নির্বাচনের কথা ভাবছেন।
বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার মাধ্যমে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে। জয়ের পরিকল্পনা থেকেই তুলনামূলক শক্ত প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে চায় ঐক্যফ্রন্ট।
সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করতে নিজ নিজ দলের মধ্যে বৈঠক করছে শরিক দলগুলো। এরপর ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে চূড়ান্ত করা হবে প্রার্থী তালিকা।
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। মনোনয়ন হারানোর শঙ্কায় আছেন বিএনপির পুরোনো প্রার্থীরা।
ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। তবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ইচ্ছা নেই তাঁর। যদিও দল ও জোট নেতারা চান, তিনি যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
আলোচনায় আছে, আইনি বাধ্যবাধকতায় খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলে ড. কামাল তাঁর আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন।তবে সেই সম্ভাবনা কম।
এমনও হতে পারে ঢাকার ধানমন্ডি আসন থেকে নির্বাচন করবেন ড. কামাল। ওই আসন থেকে এর আগেও একাধিকবার গণফোরাম থেকে নির্বাচন করেন তিনি।
আগামী নির্বাচনে দুটি আসন থেকেই নির্বাচন করার কথা ভাবছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু। সেই দুটি হচ্ছে ঢাকা-২ ও ঢাকা-৩।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা আগে ঢাকা–৩ আসনের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ২০০৮ থেকে এটি ঢাকা–২ ও ঢাকা–৩ আসনে ভাগ হয়ে যায়।’৮৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে ঢাকা–৩–এর সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।
’৯১ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান বিএনপির আমানউল্লাহ আমানের কাছে। এ আসনের চারবারের এমপি আমান এবার ঢাকা–২ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী।
আর ঢাকা–৩ থেকে বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। ২০০৮–এর নির্বাচনে তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগের নসরুল হামিদের কাছে।
মন্টু যদি এই দুই আসনের একটি থেকে নির্বাচন করতে চান সেক্ষত্রে বহু পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে বিএনপিকে। দীর্ঘদিনের পোড় খাওয়া দুই নেতার একজনকে বসিয়ে দিতে হবে।
টাঙ্গাইলের দুই আসনে কাদের সিদ্দিকী : সখীপুর ও বাসাইল উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল–৮ এবং কালিহাতি এই দুটি আসনে নির্বাচন করতে চান জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা কাদের সিদ্দিকী।
টাঙ্গাইল-৮ আসনে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ এবং ২০০১ সালে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের হয়ে সাংসদ হন কাদের সিদ্দিকী। ২০০৮ সালে নিজ দলের হয়ে লড়ে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে। এবার তিনি দুটি আসনে নির্বাচন করতে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। দুটি না পেলে টাঙ্গাইল-১ আসন তিনি হাতছাড়া করতে চাইবেন না।
মান্নার আসন বগুড়া-২ : জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আসন নিযে সবচেয়ে সুবিধায় আছেন নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না।বগুড়া-২ আসনে তার মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত।
৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনের পর এ আসনে আর কখনো নৌকা জেতেনি।
ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্না’ ৯১ থেকে তিনবার এ আসনে নির্বাচন করেছেন। প্রথমবার জনতা মুক্তি পার্টির হয়ে, পরের দুবার ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। জিততে পারেননি একবারও। তবে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হলে বিএনপি–জামায়াতের সমর্থন কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনে এগিয়ে থাকবেন তিনি।
অলি আহমদের আসনে সুব্রত : চন্দনাইশ উপজেলা ও সাতকানিয়া উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম–১৪ আসনটি ২০০৮–এর আগে চট্টগ্রাম–১৩ আসন ছিল। এ আসনের চারবার এমপি নির্বাচিত হন সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমানে এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ।
২০০৮ সালে এ দুটি আসন থেকেই প্রার্থী হন তিনি। আগামী নির্বাচনেও ২০–দলীয় জোটের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে এ দুই আসনে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে আলোচনা আছে।
তবে গণফোরামের সূত্র বলছে, অলি আহমদ চট্টগ্রাম–১৩ থেকে লড়বেন। চট্টগ্রাম–১৪ আসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে মনোনয়ন চাচ্ছেন গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী।
এ এলাকায় জামায়াতেরও প্রার্থী আছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে শাজাহান চৌধুরী এবং ২০০৮ সালে শামসুল ইসলাম জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে সাংসদ নির্বাচিত হন। এবারও তারা দলের নিবন্ধন না থাকায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে মনোনয়ন কিনেছেন।
আ স ম রব : লক্ষ্মীপুর বরাবরই বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত।’ ৯৬ সালে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে জয়ী হলেও ১৯৯১,২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে হেরে যান তিনি। এবার ঐক্যফ্রন্টের হয়ে এ আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়তে পারেন তিনি।
বিএনপি ও জেএসডির মধ্যে প্রতিবার লড়াই হয় এ আসনে। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হলে রবের জন্য অবস্থা সুবিধাজনক হবে।
কুমিল্লার দেবীদ্বারে রতন : জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন কুমিল্লা–৪ থেকে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নপ্রত্যাশী। ১৯৯১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত এ আসনটি বিএনপির দখলে ছিল। ওই সময়ে চারবারই বিএনপির প্রার্থী ছিলেন মনজুরুল আহসান মুন্সী।
কুমিল্লা উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি মনজুরুল আহসান আইনি জটিলতার কারণে ২০০৮ সালে নির্বাচন করতে পারেননি। এবারও দলের হয়ে মাঠে আছেন তিনি। স্থানীয় বিএনপির নেতা–কর্মীরা তাঁকেই আবার প্রার্থী হিসেবে চান। তাই ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন নিয়ে বিএনপি ও জেএসডির মধ্যে সমঝোতা লাগবে।
সুলতান মনসুর : কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার–২ আসনে এবার ঐক্যফ্রন্টের হয়ে লড়তে পারেন সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। এ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে তিনবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একবার এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
এ আসনে বিএনপির কখনোই ভালো অবস্থান ছিল না। বর্তমানে জাতীয় পার্টির দখলে থাকলেও সুলতান মনসুরের মাধ্যমে এটি দখলের স্বপ্ন দেখছেন বিরোধী দলের স্থানীয় নেতা–কর্মীরা। সুলতান মনসুর বর্তমানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য।
নারায়ণগঞ্জে আকরাম : নাগরিক ঐক্যের উপদেষ্টা এস এম আকরাম নির্বাচন করতে চান জন্মস্থান নারায়ণগঞ্জ থেকে । আওয়ামী লীগের হয়ে’ ৯৬ সালে নারায়ণগঞ্জ–৫ আসনে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। দলীয় বিবেদে পরে যোগ দেন নাগরিক ঐক্যে। ঐক্যফ্রন্টের হয়ে এ আসনে এবার প্রার্থী হতে চান তিনি। যদিও বিএনপির গত ছয়বারের প্রার্থী আবুল কালাম এবারও বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন।
আর বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার ব্যানারে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে জানা গেছে, ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলো যার যার মতো করে নিজেদের চাহিদার তালিকা তৈরি করছে, যা বিএনপিসংশ্লিষ্ট নেতাদের হাতে দিচ্ছে।
এর মধ্যে শরিক দলগুলোর মধ্যে যোগ্য প্রার্থী কে কোন আসনে আছেন, সে বিষয়ে বিএনপিও খোঁজখবর নিচ্ছেন। দু–এক দিনের মধ্যে এ নিয়ে শরিকদের সঙ্গে বিএনপি আলাদাভাবে বসবে।
গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠক হয়। তাতে আসন সমঝোতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা, বৈঠক শেষে এ নিয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন। জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে আরও পরে আলোচনা হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির জেষ্ঠ সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, আসন বণ্টন নিয়ে প্রত্যেক দল ও জোটের সঙ্গে বসতে হবে। তারপর আমরা ঠিক করব।
তিনি আরও বলেন, শরিক দলগুলো এখন নিজেরা গোছাচ্ছে। বিএনপিও নিজেদের মধ্যে বসে প্রার্থী বাছাই করবে। যেকোনো দলই যোগ্য বা জেতার মতো প্রার্থী পেলে তাঁকে মনোনয়ন দিতে চাইবে।