এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দলের ঐক্য ও শৃঙ্খলা ধরে রেখে মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে সর্বাত্মকভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন ধানের শীষের টিকিট প্রত্যাশীরা। শীর্ষ নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করেছেন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও চেয়ারপারসনের মুক্তির আন্দোলনের অংশ হিসেবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তারা কুণ্ঠাবোধ করবেন না। পাশাপাশি শীর্ষ নেতৃত্বের তরফেও তাদের দেয়া হয়েছে বেশকিছু নির্দেশনা। বলা হয়েছে, দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে হবে। নির্দেশনা নিয়ে নিজ নিজ এলাকায় ফিরেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। সাক্ষাৎকারে দলের হাইকমান্ড থেকে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া হলেও কোনো প্রার্থীকেই গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়নি।
সবাইকে নির্বাচন কমিশনে মনোনয়ন দাখিল করতে বলা হয়েছে। এমনকি দলের পক্ষ থেকে একটি প্রত্যয়নপত্রও দেয়া হয়েছে।
এখন তারা মনোনয়নের সবুজ সংকেতের অপেক্ষা করছেন। সেই সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছেন নির্বাচনী লড়াইয়ের। মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য বলেন, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি পরিবেশে এবার ভোট হচ্ছে। এখানে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে টিকে থাকতে হবে। ভোটের মাঠে ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাই যারা নিজ নিজ এলাকায় বিরূপ পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে ভোটের মাঠে থাকতে পারবেন, ভোটারদের সঙ্গে থাকতে পারবেন, তাদেরই মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ছাড়া গত ১০ বছরে সক্রিয় ও দলের ত্যাগী নেতাদেরকেই নমিনেশনে প্রাধান্য দেয়া হবে। সূত্র জানায়, কৌশলগত কারণে সাক্ষাৎকার শেষে মনোনয়ন চূড়ান্ত করে মনোনীতদের নাম ঘোষণা করা হয়নি। কারণ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি এখনও সমাধান হয়নি। সেটা হওয়ার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে কোনো জটিলতা তৈরি করতে চায় না বিএনপি। এ ছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে কোন্দল এড়ানো এবং তাদের মামলা-হামলা থেকে রক্ষা করতে এ বিলম্ব করা হচ্ছে।
রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গত বুধবার দিনব্যাপী ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও ঢাকা বিভাগের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে শেষ হয় বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ৪দিন ব্যাপী সাক্ষাৎকার পর্ব। এ সময় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে, এবারের নির্বাচন স্বাভাবিক পরিস্থিতির নির্বাচন নয়। একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এই নির্বাচনকে তাদের আন্দোলনের কৌশল মনে করে এই লড়াইয়ে জিততে হবে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি, দলের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা এবং গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য তাদের সংগ্রাম করতে হবে। এ সময়ে নির্বাচনী ব্যালটে সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রকাশের জন্য সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়। এদিনও ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিভিন্ন নেতার নাম ধরে ধরে জিজ্ঞেস করে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন- নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়ের দুই তিন দিন আগে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত করা হতে পারে।
তিনি সবাইকে যোগ্য আখ্যায়িত করে বলেছেন, চূড়ান্তভাবে যিনি মনোনয়ন পাবেন তখন ধানের শীষ প্রতীক প্রাপ্ত নেতা ছাড়া বাকি সবাইকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। এর আগে সবাইকে মাঠে নেমে নির্বাচনের প্রচারণায় কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে তারেক রহমান নির্দেশনা দিয়েছেন কোনোভাবেই এই নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়া যাবে না। নিজেরা ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ এই নির্বাচনে জিতলে খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে।
সাক্ষাৎকার দেয়া বেশ কয়েকজন মনোনয়ন প্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা বলছেন- প্রথমে শুরুতে সব মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পরিচয় পর্ব শেষে দলের মহাসচিব ভূমিকা বক্তব্য রাখেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান, সরকারের নির্যাতন, মামলা-হামলা, সর্বত্র দলীয়করণ, খালেদা জিয়ার কারাবরণসহ অন্যান্য বিষয়ে ব্যাখ্যা করেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই বলেও তিনি জানান। কিন্তু অস্বাভাবিক পরিবেশে তাদের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে বলে তাদেরকেও সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে। গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে বলেও তিনি জানান।
তার বক্তব্যের পরপরই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সব মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যেও দলের স্বার্থে, নেতাকর্মী ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়। এ সময়ে তিনি খালেদা জিয়ার কারাগার ও তার মুক্তির বিষয়ে বক্তব্য রাখার সময়ে উপস্থিত নেতৃবৃন্দ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা এ সময়ে তারেক রহমানকে প্রতিশ্রুতি দেন- দল যাকেই মনোনয়ন দেবে তার পক্ষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন। দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে তারা সর্বোচ্চ বিসর্জন দেয়ারও অঙ্গীকার করেন।
কিশোরগঞ্জ-৬ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম জানান, তাদের সঙ্গে তারেক রহমান যখন কথা বলেছেন তখন অনেকের চোখে পানিই দৃশ্যমান ছিল। সবাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। তাদের এখন একটাই বক্তব্য- তাদের মা’ (খালেদা জিয়া) কারাগারে। তাকে মুক্ত করতে হলে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত। ঢাকা-১৫ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুন হাসান কারাগারে থাকায় তার সহধর্মিণী ডলি হাসান সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, এই দলের জন্য তাদের পরিবারকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। নির্যাতনের কারণে পরিবারের অনেক সদস্য অকাতরে চলে গেছেন। কিন্তু এসবের থেকেও এখন বড় ইস্যু হচ্ছে দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে কারাগারে রাখা হয়েছে। তাকে মুক্ত করার জন্যই তাদের আন্দোলন। ঐক্যবদ্ধভাবে তারা নির্বাচনের আন্দোলন পরিচালনা করবেন বলেও তিনি জানান।
ঢাকা-১৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক ও দলের ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হক বলেন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিতে নেমেছি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমাদের দল বিএনপি যে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমিও সে নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে ভোটের লড়াইয়ে নামতে চাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দল যথাযথ মূল্যায়ন করবে। মনোনয়ন বোর্ডের সিদ্ধান্ত মেনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করাই হচ্ছে আমাদের অঙ্গীকার।
নেত্রকোনা-২ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. আরিফা জেসমিন নাহিন বলেন, সাক্ষাৎকারে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বক্তব্য রাখেন। তিনি নির্বাচনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার শপথ করান মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। পরিষ্কার বলেন, মায়ের মুক্তির জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। প্রশ্ন করেন- সে সংগ্রাম করতে আমরা পারবো কিনা? আমরা বলেছি, অবশ্যই পারবো। টাঙ্গাইল-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ড. ফরহাদ ইকবাল বলেন, সাক্ষাৎকার সরাসরি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গ্রহণ করেছেন। তিনি দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছেন। বলেছেন আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি। ঐক্যবদ্ধ হয়ে ধানের শীষ প্রতীকের জন্য কাজ করতে হবে। মানিকগঞ্জ-২ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী সাইফুর রহমান আসাদ বলেন, গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার, মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি মায়ের মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে যে নির্বাচন, সে ভোটযুদ্ধে কমান্ডার মনোনয়নের সাক্ষাৎকারে শীর্ষ নেতৃত্বের মুখোমুখি জাতীয়তাবাদী কমান্ডোদের সঙ্গে আমিও ছিলাম একজন সাধারণ সৈনিক। সুপ্রিম কমান্ডারের সামনে অঙ্গীকার করলাম শৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় রেখে মনোনীত কমান্ডারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চালিয়ে যাবে সর্বাত্মক লড়াই।
চট্টগ্রাম-১২ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জেলা বিএনপির সহসভাপতি সৈয়দ সাদাত আহমেদ বলেন, এই নির্বাচন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের অধিকার পুনপ্রতিষ্ঠার ও মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি মায়ের মুক্তির নির্বাচন। শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তই তাই দ্বিধাহীনভাবে শিরোধার্য করে আমরা তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ব। চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মোস্তফা নাজমুল আমিন বলেন, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলের মানুষ জাতীয়তাবাদী ঘরানার। এ আসন থেকে অতীতে একাধিকবার বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। জোটের রাজনীতির কারণে বিগত দুই নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। বারবার শরিক দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ায় নানা বঞ্চনার কারণে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা। এ আসনের ভোটাররা পরিবর্তন চায়, ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী চায়। আশাকরি, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তৃণমূলের এ প্রত্যাশার মূল্যায়ন করবেন। তবে শীর্ষনেতৃত্বের তরফে যে সিদ্ধান্তই আসবে সেটা বাস্তবায়নই আমাদের অঙ্গীকার।