এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিতদেরও মূল্যায়ন করবে ঐক্যফ্রন্ট। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের চাপ ও বাস্তবতা বিবেচনা করে ঐক্য ধরে রাখতে পরবর্তী ধাপে মূল্যায়নের আগাম এ বিষয়টি উঠে এসেছে নেতাদের আলোচনায়। নেতারা প্রাথমিকভাবে এ ব্যাপারে একটি নীতিগত সিদ্ধান্তেও পৌঁছেছেন। তবে এখনই বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে সামনে আনা হবে না। জাতীয় নির্বাচনের পর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানান, বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিটি আসনেই দলের একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে তাদের অবদান ও আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছে বিপুল ত্যাগ-তিতিক্ষা। বিশেষ করে ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন বর্জন করায় জট লেগেছে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। ফলে বেশিরভাগ আসনে মনোনয়ন চূড়ান্তকরণে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। নেতারা জানান, বিশেষ একটি পরিস্থিতিতে তারা এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় ধরনের ছাড় দেয়ার মানসিকতা নিয়েই গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফলে মনোনয়ন চূড়ান্তকরণে ছাড় দেয়ার মানসিকতা থেকে সরছে না বিএনপি। কিন্তু দুটি কারণে জটিলতা হয়েছে এ মনোনয়ন চূড়ান্তকরণে। প্রথমত, ফ্রন্ট ও ২০ দলের অংশীদার প্রতিটি দলের তরফে যতগুলো আসন দাবি করা হয়েছে সেটা ভোটের হিসাব বিবেচনায় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অন্যদিকে কিছু কিছু আসনে বিএনপির জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী প্রার্থীর বিপরীতে ফ্রন্টের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মনোনয়ন চেয়েছেন। দুটি বিষয়েই জটিলতা নিরসন বেশ কঠিন। তবে মনোনয়ন জটিলতা নিরসনে সংশ্লিষ্ট দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তারা আশা করছেন, আগামী দু-একদিনের মধ্যেই আলোচনাসাপেক্ষে বেশিরভাগ স্থানে জটিলতা নিরসন হবে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা জানান, বিএনপি কতগুলো আসনে ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের ছাড় দেবে- এটা নিয়েও এখনো ধোঁয়াশা কাটেনি। তবে সব মিলিয়ে ৭০টির মতো আসনে ছাড় দেয়া হতে পারে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। যদিও ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্টের তরফে চূড়ান্তভাবে ১০০-র মতো আসনে মনোনয়ন চাইছে। তারা বলেন, জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া যাবে ৩০০ আসনে। কিন্তু মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অন্তত ১২০০ জন। ফলে সবাইকে মনোনয়ন দেয়া সম্ভব নয়। বাস্তবতার নিরিখেই কিছু নেতাকে স্যাক্রিফাইস করতে হবে। বিএনপি ও ফ্রন্টের নেতারা জানান, বিএনপির তরফে সর্বোচ্চ ছাড় দেয়ার মানসিকতা পোষণের পরও জোট এবং ফ্রন্টের অনেক নেতাই মনোনয়ন বঞ্চিত হবেন। নিজ নিজ দলের হিসাবে তারা বড় নেতা হলেও ভোটের হিসাবে তাদের অবস্থান অতটা মজবুত নয়। কিন্তু এবার কেবল নির্বাচনে অংশগ্রহণই নয়, বিজয়ের জন্যই লড়তে হবে। আর সে বিবেচনায় তৃণমূলে শক্ত অবস্থান রয়েছে এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে পারবেন এমন নেতাদেরই প্রাধান্য দেয়া হবে চূড়ান্ত মনোনয়নে। এতে জোট এবং ফ্রন্টের পাশাপাশি বিএনপির অনেক নেতাকেও স্যাক্রিফাইস করতে হবে। কিন্তু এ ছাড় দেয়ার বিষয়টি নিয়ে ফ্রন্টে অনৈক্য তৈরি হতে পারে। বিষয়টি মাথায় রেখেই তাই বঞ্চিতদের কীভাবে মূল্যায়ন করা যায় তা নিয়ে আগাম আলোচনা উঠে আসে ফ্রন্ট নেতাদের আলোচনায়। সেখানে কয়েকজন নেতা বলেন, বিএনপিসহ ফ্রন্টের দলগুলোর অবস্থান শেষ পর্যন্ত নির্বাচনমুখী। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন। সে হিসেবে আগামী বছরের দ্বিতীয় মাসেই উপজেলা চেয়ারম্যানদের মেয়াদ শেষ হবে। জাতীয় নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় সে নির্বাচনেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। এতে জাতীয় নির্বাচনে ফ্রন্টের মনোনয়ন বঞ্চিতদের একটি বড় অংশকেই মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। যারা জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে উপজেলা ও পৌর মেয়র নির্বাচনে। আলোচনার টেবিলে বিষয়টি উত্থাপিত হলে প্রাথমিকভাবে নেতারা একমত পোষণ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে এখন কেবল একাদশ জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্রিক বিরোধী দলীয় প্লাটফর্ম বিবেচনা করছে না বিএনপি। ফলে জাতীয় নির্বাচনের পর উপজেলা ও পৌরসভার মতো স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করলে সর্বস্তরে এ ফ্রন্টের ঐক্য যেমন মজবুত হবে তেমনি প্রশাসনিক জনপ্রতিনিধিত্বও হাতের মুঠোয় আসবে। বিএনপি সূত্র জানায়, জাতীয় স্বার্থে ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য ধরে রাখতে যেসব বিএনপি নেতা ফ্রন্টের নেতাদের মনোনয়ন স্যাক্রিফাইস করবেন তাদের স্থানীয় নির্বাচনের পাশাপাশি যোগ্যতা অনুযায়ী দলে সাংগঠনিকভাবেও মূল্যায়ন করা হবে। একইভাবে যেসব জোট ও ফ্রন্ট নেতা বিএনপি প্রার্থীকে স্যাক্রিফাইস করবেন তাদের মূল্যায়ন করা হবে স্থানীয় নির্বাচনে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচন। ১৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে চারধাপে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। একতরফা দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেও দেড় মাসের মাথায় স্থানীয় নির্বাচনের অংশ নিয়েছিল বিএনপি। প্রথম পর্বের নির্বাচনে ৯৭টি উপজেলার মধ্যে ৫০টির বেশি উপজেলায় বিজয়ী হয়েছিল বিএনপি ও জামায়াতসমর্থিত প্রার্থীরা। তবে পরে অবশ্য বিজয়ের সে ধারাবাহিকতা আর বজায় থাকেনি।
এদিকে একাদশ জাতীয় নির্বাচনে দল ও দেশের বৃহত্তর স্বার্থে মনোনয়ন স্যাক্রিফাইস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী প্রার্থী। ফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নির্বাচনী এলাকা লক্ষ্মীপুর-৪। কিন্তু এই আসনে রয়েছেন বিএনপির একাধিকবারের সাবেক এমপি আশরাফউদ্দিন নিজান ও জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি শফিউল বারী বাবু। বিশেষ করে সাবেক এমপি নিজানের পক্ষে সমর্থন ধরে রাখতে চেয়েছিলেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু আ স ম রব ওই আসনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত স্যাক্রিফাইসের সিদ্ধান্ত নেন আশরাফউদ্দিন নিজান। তার এই সিদ্ধান্তটি দলের মহাসচিবের পাশাপাশি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অবহিত করেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দলের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল। এবার দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের অনড় অবস্থানের কারণে তার আসন পাল্টে মনোনয়ন দেয়া হয় ঢাকা-৯ আসনে। ওই আসনে আবার মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাসকেও মনোনয়ন দেয়া হয়। ফলে সে আসনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নেন হাবিব উন নবী খান সোহেল। ঢাকা-১২ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুল আলম নিরব। কিন্তু ঐক্যফ্রন্টের ঐক্য ধরে রাখার স্বার্থে তাকে স্যাক্রিফাইস করতে হচ্ছে। একইভাবে টাঙ্গাইলের একটি আসনে ফ্রন্টের শরিক দল কৃষক শ্রমিক জনতা পার্টির প্রার্থীকে ছাড় দিতে ওই আসনে মূল মনোনয়ন দাবিদার দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমদ আজম খানকে প্রাথমিক মনোনয়নের চিঠিই ইস্যু করেনি বিএনপি।