এশিয়ান বাংলা ডেস্ক : মিয়ানমারের তরুণ সমাজের কাছে ক্রমেই অং সান সুচির আবেদন হারাচ্ছে। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন তারা। নতুন এমন প্রবণতা নিয়ে ইয়াঙ্গুন থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স একটি ফিচার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে সুচিকে ‘হারানো আদর্শ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এতে বলা হয়, মিয়ানমারের তরুণ অধিকারকর্মী ও টেলিভিশন উপস্থাপিকা থিনজার শুন লি ই (২৭) এক সময় বলতেন, অং সান সুচির সবচেয়ে বড় ভক্তদের অন্যতম তিনি। কিন্তু এখন সেই সুচির সবচেয়ে কড়া সমালোচকদের অন্যতম হয়ে উঠেছেন সেই থিনজার শুন লি ই। উচ্চ পদমর্যাদার উদার অধিকারকর্মীদের একটি ছোট্ট গ্রুপ গড়ে উঠেছে মিয়ানমারে। এ গ্রুপটির বেশিরভাগই অং সান সুচির এক সময়ের কট্টর সমর্থক ছিলেন।
কিন্তু তারা তিনবছর আগে আকাশসম আশা নিয়ে যে সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিলেন ভোটের মাধ্যমে, তা এখন ক্রমেই বিরক্তিতে পরিণত হচ্ছে। জনপ্রিয় একটি স্থানীয় ওয়েবসাইটের ‘আন্ডার ৩০’ নামের একটি টক শোয়ের উপস্থাপিকা থিনজার শুন লি ই। তিনি বলেছেন, আমি আমার আইডলকে হারিয়ে ফেলেছি। আমি দ্বিধান্বিত, হতাশাগ্রস্ত। তার ভাষায়, এখন বেশিরভাগ অধিকারকর্মী ও তরুণরা ভাবছেন: এরপরে কি, কি ঘটতে যাচ্ছে? আমরা কি করতে পারি? এমন সময়ে অং সান সুচি তার নিজের মতো করে পথ চলছেন। তার সেই চলার পথে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। তিনি নাগরিক সমাজের কোনো সংগঠনের কথা শোনেন না। মিয়ানমারের অধিবাসীদের মধ্যে একনিষ্ঠতা বাড়ানোর জন্য অব্যাহতভাবে কাজ করছেন সুচি। তবে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে তিনি যেভাবে মোকাবিলা করছেন এবং মিডিয়া ও নাগরিক সমাজকে যেভাবে দমিয়ে রাখছেন তাতে তরুণদের মধ্যে ভিন্নমতের উত্থান হচ্ছে। এটা তার প্রশাসনের জন্য একটি নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। ২০২০ সালে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। আর সেই সঙ্গে অধিকারকর্মী বা এক্টিভিস্টদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভক্তির মুখে পড়তে হচ্ছে কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম বেসামরিক সরকারকে। সুচির ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসির (এনএলডি) মুখপাত্র মাইও নুন্ট বলেছেন, তাদের দল তরুণ সমাজকে জয়ের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য শিক্ষা ও ভকেশনাল প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, তরুণ সমাজ ও জনগণ আমাদের সরকারের কাছে প্রচুর প্রত্যাশা করে। আমরা তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারি নি। এ কথা স্বীকার করি। কিন্তু আমরা সর্বোত্তম চেষ্টা করে যাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসেন অং সান সুচি। তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কার ও দেশে দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধের ইতি ঘটানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তারপর থেকে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার জন্য তার সরকার রয়েছে প্রচণ্ড চাপে। জাতিসংঘ ওই নৃশংসতাকে জাতি নিধন ও গণহত্যার উদ্দেশ্যে হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছে।
এক্টিভিস্টরা বলছেন, মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ক্রমেই কর্তৃত্ববাদী সরকারে পরিণত হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠকে চেপে ধরতে ঔপনিবেশিক আমলের আইনগুলোকে বাতিল করতে পার্লামেন্টে তার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। উল্টো তারা নাগরিক সমাজের ওপর কঠোর করেছে বিধিনিষেধ।
সাম্প্রতিক সময়ে অধিকারকর্মীরা দেশটিতে বেশ কয়েক দফা বিক্ষোভ করেছেন। মে মাসে তারা বাণিজ্যিক রাজধানী বলে পরিচিত ইয়াঙ্গুনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ করেছেন। ওই বিক্ষোভের জন্য থিনজার শুন লি ই সহ মোট ১৭ জনের বিরুদ্ধে বেআইনি বিক্ষোভ করার জন্য অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই তালিকা দীর্ঘায়িত হচ্ছেই।
থিনজার শুন লি ই বলেন, স্পর্শকাতর ইস্যুগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদেরকে প্রহার করা হয়েছে। গণতন্ত্র নাম ব্যবহারকারী দল ন্যাশনাল লিগ অব ডেমোক্রেসি’কে অবশ্যই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
মুক্ত মত প্রকাশের সংগঠন আথান। মিয়ানমারের ভাষায় এর অর্থ হলো কণ্ঠস্বর। তাদের মতে, অং সান সুচি ক্ষমতায় আসার পর ৪৪ জন সাংবাদিক ও ১৪২ জন অধিকারকর্মীকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। আথানের প্রতিষ্ঠাতা, কবি ও অধিকারকর্মী মাউং সাউং খা তাদের একজন। থিনজার শুন লি ই’র পাশাপাশি মে মাসে তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এর চারমাস পরে সেপ্টেম্বরে তারা দু’জনেই আরেকটি বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এবারের বিক্ষোভের প্রতিপাদ্য হলো মুক্তমত।
ওই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন মাউং সাউং খা। তিনি এখনো এনএলডির একজন সদস্য। বিক্ষোভে যোগ দেন দলীয় কমলা রঙের শার্ট পরে। তার ওপর পরেন সেনাবাহিনীর মতো একটি সবুজ জ্যাকেট। তিনি বলেন, সরকার মানুষের অধিকার রক্ষায় তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে দলীয় মুখপাত্র মাইও নুন্ট বলেছেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে সরকার। তাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড যাচাই করে দেখার দরকার আছে।
রোহিঙ্গাদেরকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করায় নিন্দা জানিয়েছেন মাউং সাউং খা। তিনি বলেছেন, আমরা রোহিঙ্গাদের স্বীকার করি। কিন্তু তাদেরকে বাঙালি হিসেবে অভিহিত করাকে পুরোপুরি নিন্দা জানাই। যেসব অন্যায় হয়েছে তার কোনো স্বীকারোক্তি বা তার জন্য কোনো শাস্তি আমরা দেখি নি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মানুষের অধিকারকে যতক্ষণ কম করে দেখা হবে এবং তাদেরকে হত্যা করাকে অপরাধ হিসেবে দেখা হবে না, ততক্ষণ ওইসব শরণার্থীরা (রোহিঙ্গা) ফিরে আসবে না।
আরেকজন তরুণ অধিকারকর্মী খিন সান্দার। তার বিরুদ্ধে বেআইনি প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে এনএলডির জন্য প্রচারণায় তিনি বেশ কয়েক মাস কাজ করেছেন। কিন্তু রাখাইন সংকট যেভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে সে জন্য অং সান সুচির ওপর আস্থা হারিয়েছেন তিনি।