এশিয়ান বাংলা স্পোর্টস : অগ্রহায়ণের মোলায়েম রোদমাখা অপরাহ্নে তাইজুল লুইসকে লেগ-বিফোর করতেই শেরেবাংলায় যেন একসঙ্গে জ্বলে উঠল সহস্র সূর্য! মিরপুর টেস্টের বয়স তখনও তিনদিন হয়নি। তাতে কার কী করার আছে! ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামর্থ্য যে তিনদিনেই সীমাবদ্ধ! তাই তো তৃতীয়দিনের চা-বিরতি পিছিয়ে দেয়া হয়।
খানিক পরে চা-টা খেলে কিইবা এসে যায়। ২টা ৪০ মিনিটে একতরফা ও একপেশে টেস্টের যখন যবনিকাপাত ঘটে, বাংলাদেশ ইতিহাসের চৌকাঠে পা রেখেছে। শুভ্র পোশাকের ক্রিকেটে নিজেদের সবচেয়ে বড় জয়- ইনিংস ও ১৮৪ রানে। সেই সঙ্গে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ ২-০তে জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ হোয়াইটওয়াশ। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে এটি দ্বিতীয় টেস্ট সিরিজ জয় বাংলাদেশের।
আগেরটি ছিল ২০০৯ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। মিরাজের মেহেদি রাঙানো হীরণ্ময় স্পিন-ঐশ্বর্যে মধুর প্রতিশোধের জয়ে মোহনীয় অপরাহ্ন আরও অপরূপ হয়ে ওঠে। ম্যাচে ১১৭ রানে ১২ উইকেট টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো বোলারের সেরা অর্জন।
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এক টেস্টে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন মিরাজ। কিন্তু রান দিয়েছিলেন ১৫৯। রবিবাসরীয় মিরপুর মিরাজকে বসাল রাজাসনে। ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্টাম্প তুলে নিলেন। যে বলে তার ঈর্ষণীয় কীর্তি, সেটিও রেখে দিলেন নিজের কাছে। আজ থেকে বহু বছর পর বার্ধক্যের বারান্দায় স্মৃতির রোদ গায়ে মেখে মিরাজ তার নাতি-নাতনিদের গল্পটা শোনাবেন, ‘বুঝেছিস, ১২ উইকেট নিয়েছিলাম …।’
বাংলাদেশের চার স্পিনারের মায়াবী ঘূর্ণির ফাঁদে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হয় ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানদের। ভাবলেও অবাক লাগে, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে স্যার গ্যারি সোবার্স, রোহান কানহাই, আলভিন কালীচরণ, ভিভ রিচার্ডস, ব্রায়ান লারা, শিবনারায়ণ চন্দরপলদের মতো ক্লাসিক ব্যাটসম্যান উঠে এসেছেন।
তাদের উত্তরসূরিরা টেস্টের মেজাজ বিসর্জন দিয়ে টি ২০-র আমেজে ব্যাট করে আত্মাহুতি দিয়েছেন। দীপশিখার দিকে পতঙ্গ যেমন ছুটে যায় আত্মহননের আনন্দে। সাকিব আল হাসানকে এক ওভারে তিনটি ছক্কা হাঁকানো শিমরন হেটমায়ারের ৯৩ রানের ইনিংস ছিল বিনোদনে ভরপুর। কিন্তু তিনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে, এটা টেস্ট ম্যাচ। টি ২০ জলসা নয়।
১৫ উইকেটপ্রসবা তৃতীয়দিনে হেটমায়ারের ব্যাটিংয়ে হয়তো খানিকটা আত্মশ্লাঘা বোধ করতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারচেয়ে বেশি আক্ষেপে পুড়ছে তারা। পায়ের নড়াচড়া ভুলে যেতে বসা ক্যারিবীয় ব্যাটসম্যানরা টেস্ট ঘরানায় আভিজাত্য বিসর্জন দিতে বসেছেন।
টেস্ট আঙিনায় দেড় যুগের পথ চলায় প্রথমবারের মতো প্রতিপক্ষকে ফলো-অন করিয়ে ইনিংস ও ১৮৪ রানের অবিস্মরণীয় জয়। ম্যাচ শেষ আট সেশনে। ২০০৯ সালের সেন্ট জর্জের স্মৃতি ফিরে এলো মিরপুরে। দ্বিতীয়বারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ২-০তে হারিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে বড় দল হয়ে ওঠার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ।
মাত্র পাঁচ মাস আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পেসারদের দাপটে ২-০তে নাস্তানাবুদ হয়ে এসেছেন সাকিবরা। ফিরতি সিরিজে এবার বাংলাদেশের অস্ত্র স্পিন। পেসের জবাবে ঘূর্ণিজাদু। চার স্পিনারের প্রলয় নাচনে চোখে সরষেফুল দেখল উইন্ডিজ। প্রথম টেস্ট শেষ হয়েছিল তিনদিনে, দ্বিতীয়টিও তাই। প্রথমবারের মতো স্পিনাররাই দুই টেস্টের সিরিজে নিলেন প্রতিপক্ষের পুরো ৪০ উইকেট।
মধুর প্রতিশোধে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ৪৩ রানে অলআউট হওয়ার ক্ষতেও কিছুটা হলেও প্রলেপ পড়ল। টেস্টে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হার উইন্ডিজের বিপক্ষে।
তাদের বিপক্ষেই সবচেয়ে বড় জয়ে অনেক জ্বালাই জুড়িয়েছে। প্রথম ইনিংসে ৫০৮ রান করার পর সাকিবও বুঝতে পারেননি যে এত বড় জয় অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের সামনে। ম্যাচ শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে সাকিব বললেন, ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের কন্ডিশনের সুবিধা নিতে পেরেছে, আমরা আমাদের কন্ডিশনের সুবিধা নিয়েছি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাজেভাবে হারের পর আমাদের নিজেদের কিছু প্রমাণ করার ছিল। সেটা করতে পারায় খুশি।’
মিরপুরে জয়ের সুবাস আগেরদিনই পেয়েছিল স্বাগতিকরা। কাল ৭৫ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে খেলতে নামা সফরকারীরা দাঁড়াতেই পারেনি। কয়েকদিন আগে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের ইয়াসির শাহ একদিনে নিয়েছিলেন ১০ উইকেট। মিরাজ কাল নিলেন নয়টি। আগের দিনের তিন উইকেটের পর কাল প্রথম ইনিংসে চারটি, পরে দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছেন আরও পাঁচটি। সকালে মিরাজের শুরুটা হয়েছিল প্রথম বলে হেটমায়ারের ছক্কা খেয়ে। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই সেই হেটমায়ারকে ফিরতি ক্যাচে ফেরান এই অফ-স্পিনার।
নিজের পরের চার ওভারে আরও তিনটি নিয়ে তুলে ফেলেন সাত উইকেট। এক ইনিংসে যা বাংলাদেশের তৃতীয় সেরা বোলিং ফিগার। প্রথম ইনিংসের শেষ আঁচড়ে লুইসকে ফিরিয়ে সাকিব নেন তিন উইকেট। সাকিব-মিরাজেই প্রথম ইনিংসে ১১১ রানে অলআউট হয়ে ফলো-অনে পড়ে উইন্ডিজ। প্রতিপক্ষকে এটাই সবচেয়ে কম রানে অলআউটের রেকর্ড বাংলাদেশের। লিড ৩৯৭ রানের।
মিরপুরেই ২০ দিন আগে জিম্বাবুয়েকে ফলো-অন করানোর সুযোগ পেয়েও মাহমুদউল্লাহ সাহস পাননি। সাকিব ম্যাচের দৈর্ঘ্য আর বড় করতে চাইলেন না।
ফলো-অনে নামিয়ে আবারও প্রথম ওভারে প্রতিপক্ষের অধিনায়কের উইকেট নিয়ে সাকিবের শুরু। এই দুই টেস্টে প্রায় প্রতি ইনিংসেই শুরুর উইকেট এনে দিয়েছেন সাকিব। পরে আবার সেই মিরাজ। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য তাইজুল তিনটি ও নাঈম হাসান একটি উইকেট নিয়েছেন। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ারিক্যানকে আউট করে মিরাজ ম্যাচে দ্বিতীয়বার পাঁচ উইকেট তুলে নেন।
এরপর তাকে আর বোলিংয়ে আনা হয়নি। শেষটা হয় তাইজুলে। চট্টগ্রামের পর মিরপুরের বাইশ গজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের জন্য মারণাস্ত্র সেই স্পিন। তবে উইকেটে বাংলাদেশের বোলাররা খুব বেশি টার্ন পাননি।
উইকেটে যে জুজু নেই, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন শিমরন হেটমায়ারও। দ্বিতীয় ইনিংসে নয়টি ছক্কা মেরেছেন তিনি। হেটমায়ারকে ৯৩ রানে ফিরিয়ে ব্যক্তিগত সাফল্যটুকুও পেতে দেননি মিরাজ। দুই টেস্টের চার ইনিংসেই এই আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়েছেন তিনি। প্রথম ইনিংসে মাহমুদউল্লাহ খেলেছেন ২৪২ বল, সাদমান ইসলাম ১৯৯ এবং সাকিব ১৩৯ বল।
অথচ সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের একজনই মাত্র একশ’র বেশি বল খেলতে পেরেছেন। প্রথম ইনিংসে হেটমায়ার খেলেন ১০১ বল। সামনে নিউজিল্যান্ড সফর। সেখানে চার স্পিনার নীতি কার্যকর হবে না। পেস স্বর্গে গিয়ে কী হতে পারে- আগে সেটা না ভেবে স্পিনারদের জয়জয়কারের সিরিজটা উপভোগ করতে চান সাকিবরা।