এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। স্বৈরশাসক। পতনের পরও মঞ্চে ফিরেছেন। যেটা তামাম দুনিয়ার ইতিহাসেই ব্যতিক্রম। তিনি কোনো স্বাধীন রাজনীতিবিদ নন। একথা তিনি বারবার বলে গেছেন। এবং এটা কবুল করতে আসলে কখনোই কারও আপত্তি ছিল না। রাজনীতিতে তিনি বার বার রহস্য তৈরি করেছেন।
কখনো আবার শিকার হয়েছেন অপার রহস্যের। যখন তার নিজের কিছু করার ছিল না। বঙ্গভবন, সাব-জেল, হাসপাতাল সবই তার বড় চেনা।
সামনে নির্বাচন। আবারো এরশাদকে নিয়ে রহস্য তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন খবর। কোন্টা সত্য, কোন্টা মিথ্যা বলা মুশকিল। এরশাদ সর্বশেষ প্রকাশ্যে এসেছিলেন গত ২০শে নভেম্বর। সেদিন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রেখেছিলেন। বলেছিলেন, কোন জোটে যাবেন সে সিদ্ধান্ত তিনি নিজেই নেবেন। সে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ কী তিনি পেয়েছেন? কী সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন এরশাদ। গত দুই সপ্তায় এরশাদকে আর প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এরই মধ্যে তার দলের মহাসচিব বদলে গেছে। রুহুল আমিন হাওলাদার জানিয়েছিলেন, সহসাই এরশাদ প্রকাশ্যে আসবেন। কিন্তু এরপর অনেকটা আচমকাই বাতিল হয়ে যায় হাওলাদারের মনোনয়ন। মহাসচিব পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে। এ ব্যাপারে এরশাদের সরাসরি কোনো বক্তব্য এখনো পাওয়া যায়নি।
নতুন মহাসচিব ও মন্ত্রিসভার সদস্য মশিউর রহমান রাঙ্গাই যা বলার বলছেন, এরশাদ ও হাওলাদার দুইজনই নীরব। রাঙ্গা অবশ্য ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন তা পরিষ্কার নয়। একবার বলছেন, এরশাদ ভালো আছেন। আবার বলছেন, এরশাদ চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবেন। সর্বশেষ জানিয়েছেন, এরশাদ অসুস্থ অবস্থায় বাসায় একা থাকতে ‘ভয়’ পান বলেই মাঝেমধ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যান। মঙ্গলবার বনানীতে পার্টি চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাঙ্গা বলেন, ঘুমের ডিস্টার্ব হলেও এরশাদ সিএমএইচে যান। বাসায় একা থাকেন বলে তার একলা লাগে, ভয় করে। তাছাড়া ইনফেকশনের ভয়ও আছে। রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা কমে যাওয়ার পর শারীরিক অবস্থা নিয়ে এরশাদ ভয়ে থাকেন বলে তথ্য দেন তিনি। সোমবার রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও রাঙ্গা এদিন নতুন তথ্য দেন যে, হাওলাদার নিজেই পদত্যাগ করেছেন।
এই অবস্থায় এই প্রশ্ন আরো বড় হচ্ছে যে, প্রেসিডেন্ট পার্কে কী অবস্থায় আছেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি কি স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন। না কি নানামুখী চাপের কারণে দলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। এমনিতে মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে প্রচণ্ড চাপে ছিলেন এরশাদ। রুহুল আমিন হাওলাদারের পাশাপাশি তার বিরুদ্ধেও অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রশ্ন তুলেছিলেন। দুই/তিন বছর থেকেই তিনি বলে আসছিলেন, জাতীয় পার্টি তিনশ’ আসনেই প্রার্থী দেবে। ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। এসব কী ছিল তবে বাৎ কী বাৎ। প্রতিটি নির্বাচনের আগেই সিদ্ধান্ত নিতে এরশাদ নানা নাটকীয়তা তৈরি করেন। বিশেষ করে জোট রাজনীতির যুগে তিনি বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন। চারদলীয় জোট গঠনের সময় তিনি ঐক্যের কাবিননামায় সই করেছিলেন। কিন্তু পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
২০০৬ সালে যখন তার বিএনপি জোটে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত মনে হচ্ছিলো তখন তিনি আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দেন। ঘোষণা দেন, আমি সৈনিক। মৃত্যুকে পরোয়া করি না। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন ঘিরেও এরশাদ আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হঠাৎ করেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন। কিন্তু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েও তিনি সরতে পারেন নি। তাকে এমপি ঘোষণা করা হয়। পরে অবশ্য তিনি সবই মেনে নেন।
তবে ওই নির্বাচনের পর থেকে দৃশ্যত জাতীয় পার্টির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রওশন এরশাদের হাতে। যে নিয়ন্ত্রণ এখন পর্যন্ত আর আলগা হয়নি। এরশাদ কখনো কখনো চেষ্টা করেছেন। তবে তাতে ফল আসে নি। এরশাদ কোনো ফল চেয়েছিলেন কি-না তা নিয়েও বিতর্ক আছে। কোনো কোনো সূত্র দাবি করছে, একাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরেও নাটকীয় পরিস্থিতির অবতারণা করতে চেয়েছিলেন এরশাদ। তার সিঙ্গাপুর সংযোগকেও দেখা হয়েছিল সন্দেহের চোখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এরশাদ যেন কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারেন তা নিশ্চিত করা হয়েছে সুকৌশলে। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষদিন পর্যন্ত হয়তো এটা নিশ্চিতই থাকবে। একসময়কার প্রচণ্ড প্রতাপশালী শাসক এরশাদ। সম্ভবত, জীবনের অন্য অধ্যায়টা এখন ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন তিনি।