এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু এবং দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষ ভূমিকা চাইলেন রাজনীতিক, কূটনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। কানাডিয়ান হাইকমিশন, পর্যবেক্ষক সংস্থা এনডিআই ও আইআইডির যৌথ উদ্যোগে কূটনৈতিক জোনে এক ‘পলিসি ব্রেকফাস্ট’ বৈঠকে বুধবার আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়। রুদ্ধদার ওই বৈঠকের মুখ্য আলোচনার বিষয় ছিল নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে সংশয়ের বিষয়টি। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিরোধী দলের নেতারা ভোটের পরিবেশ নিয়ে সরকারের প্রতি নানা অভিযোগের আঙুল তুলেন। জবাবে সরকারি দলের প্রতিনিধিরা বলেন, এখন সব বিষয় নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এখানে সরকারের কিছুই করার নেই। আলোচনায় জাতিসংঘসহ পূর্ব-পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনার ছাড়াও জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরা অংশ নেন। আলোচনায় ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দু’জন উপদেষ্টা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সরকারি দলের নীতি নির্ধারকরা।
ছিলেন বিএনপির শীর্ষ দুই নেতাও। অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজ এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরাও অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
৩ ঘণ্টার ওই আলোচনায় প্রশ্ন আসে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতার সঙ্গে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারছে কি না? জবাবে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা কূটনীতিকদের কাছে তাদের নিজ নিজ বক্তব্য তুলে ধরেন। নির্বাচনী পরিবেশ এবং নির্বাচন সংক্রান্ত নানা বিষয়ে রাজনৈতিক দল ছাড়াও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত দেন। বিবিসি বাংলা জানিয়েছে- বৈঠক শেষে বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, তিনি নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কথা বলেছেন। নির্বাচন কমিশন যাতে নিরপেক্ষতার সঙ্গে রেফারির ভূমিকা পালন করে সেটি তুলে ধরেছেন। নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধিকে উদ্ধৃত করে বিবিসি বাংলা এ সংক্রান্ত তাদের রিপোর্টে জানিয়েছে-বৈঠকে বাংলাদেশ একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে কিনা সেটি ভেবে দেখার কথাও বলা হয়েছে। বিগত কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে সেখানে বলা হয়, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। প্রথমত, নির্বাচনের আগে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং নানা ধরনের মামলার মাধ্যমে ঘরছাড়া করা।
দ্বিতীয়ত ভোটের দিন বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেয়া এবং সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে, ভোট কেন্দ্র আংশিক কিংবা পুরোপুরি দখল করা। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে এ ধরনের পরিস্থিতি ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি। বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন তাদের দল কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, এখন তো সরকার আর নির্বাচন কমিশন একাকার হয়ে গেছে। সরকার নির্বাচন কমিশনকে প্রোটেকশন করতেই ব্যস্ত। এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দূরের কথা, আমরা প্র্যাকটিকালি নিচের দিকে যাচ্ছি। এ বৈঠকে বিএনপির তরফে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে তার জবাব দিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে নির্বাচন কমিশন অতীতে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এখন মোটামুটি একটি শক্তিশালী অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিনিধি দলের অন্যতম এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য মেহজাবিন খালেদ পাল্টা অভিযোগ করেছেন, বিএনপি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। তিনি বলেন, তারা (বিএনপি) তাদের প্রার্থীদের নমিনেশন বাতিলের জন্য সরকারকে দায়ী করছে। অথচ এতে সরকারের কোনো দায় বা দায়িত্ব নেই। এটা পুরোপুরি ইলেকশন কমিশনের ব্যাপার। এটা তাদের দায়িত্ব। বিবিসির রিপোর্ট মতে ওই আয়োজনে সরকার, বিরোধী দল এবং অন্যদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন কূটনীতিকরা। তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। আর এতে নির্বাচন কমিশনের শক্তিশালী ভূমিকাও চেয়েছেন তারা।
বৈঠক শেষে যে যা বললেন: এদিকে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, একাদশ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবকিছু করছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে কিছু সমস্যা আছে, তা সমাধানে আমরা চেষ্টা করছি। সকল রাজনৈতিক দল ও গণমাধ্যম নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করতে হবে। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখানে মূলত নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য যে প্রয়োজনীয়তা সেটা আমরা বলেছি। বর্তমান যে প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না হওয়া সত্ত্বেও আমরা নির্বাচনে এসেছি। এখন আমরা নির্বাচনে আসার পর দেখছি আমাদের জার্নি হচ্ছে লং হিল জার্নি, আমরা আরো নিচের দিকে যাচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা আশা করি- এটা ক্র্যাশ না করে। আমরা আশা করি নির্বাচনের বাকি যে দিনগুলোতে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এই পর্যন্ত জনগণের কোনো আস্থা সৃষ্টি হয়নি। বস্তুতপক্ষে নির্বাচনটি নির্বাচনের আগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন কারণে। এই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে যদি বেরিয়ে আসতে চান তাহলে তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা একটি ?নিরপেক্ষ নির্বাচন চান। নইলে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন আরো ‘খারাপের’ দিকে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আজকে নির্বাচিত সরকার নেই, নির্বাচিত সংসদ নেই, নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। দেশের মানুষ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়, একটি নির্বাচিত সরকার ও সংসদ দেখতে চায়। কিন্তু এখানে সমস্যা হচ্ছে পুরো নিয়ন্ত্রণটা সরকারের হাতে, নির্বাচন কমিশনের হাতে নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কীভাবে? আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপুু মনি বলেন, নির্বাচনটা কীভাবে আরো ভালো করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমাদের যে বক্তব্য সেটা হলো গত ১০ বছরে ও তার আগে ২০০৭-০৮ সালেও নির্বাচনী পুরো প্রক্রিয়ায় যে ধরনের সংস্কার করা হয়েছে যা প্রত্যেকটির উদ্যোগ ছিল আওয়ামী লীগের উদ্যোগ।
ওই সব সংস্কারের মাধ্যমে আজকে একটা সিস্টেম দাঁড়িয়েছে যার মাধ্যমে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। সেই নির্বাচনে যে পক্ষ-প্রতিপক্ষ আছে তাদের অবশ্যই ভূমিকা রয়েছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যেন সঠিক ভূমিকা পালন করে। আওয়ামী লীগ সরকারে আছে আমরা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছি এবং করবো। আমরা সবাইকে নিয়ে যে নির্বাচন করতে চাই, সেটা ভালো নির্বাচন করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী যে সংলাপ করেছে তার মধ্য দিয়ে এবং নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা তার প্রমাণ করছি। ডা. দীপু মনি বলেন, সরকারের যেটি উদ্দেশ্য সেটি হচ্ছে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে নির্বাচন করবে। সরকার তাকে সাংবিধানিক যে দায়িত্ব আছে সেই দায়িত্ব অনুযায়ী সর্বাত্মক সহযোগিতা দেবে এবং সরকার সেটি করে যাচ্ছে। আলোচনা কী হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে দীপু মনি বলেন, ভেতরে আলোচনার কথা এখানে বলবার কথা না। তবে আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই।
সবাই সেটি আশা করেন এবং অতীতের চাইতে আমরা এখন যে পদ্ধতিগুলো আছে চতুর্দিকে যেভাবে ডিজিটাইলেজশন বলেন, মিডিয়ার ব্যাপকতা বলেন, তাতে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। সেটিকে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ব্রতী’র প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশিদ বলেন, এই ধরনের আলোচনা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যেহেতু এখানে নির্বাচনের সব অংশীদাররা উপস্থিত ছিলেন। সেই জায়গাটা থেকে বলা হয়, সকলেই তাদের জায়গা থেকে তাদের সমস্যাগুলো উত্থাপন করেছেন। সরকারের যারা প্রতিনিধি ছিলেন, তারাও যথেষ্ট খোলাসাভাবে তাদের বোধগুলো পেশ করেছেন। আমরা আশা করি এই ধরনের আলোচনা সবার মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করবে, টেনশন ও অস্থিরতা কমাবে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে নির্বাচনের পরিবেশ সম্পর্কে বৈঠকে তাদের মতামত সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে শারমিন মুুরশিদ বলেন, আমরা আগামী দিনের দিকে তাকাতে চাই।
আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলো একটু সহনশীল হয়। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভূমিকাটা শক্ত করার জন্য সরকারি দল কমিশন থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। আমাদের বক্তব্য ছিল নির্বাচন কমিশনের ইন্ডিডেন্স প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো তার থেকে দূরত্ব রক্ষা করবে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখানে যে জিনিসটা উঠে এসেছে- আগামী নির্বাচন যদি গ্রহণযোগ্য না হয় দেশে-বিদেশে যদি দৃশ্যমান ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন না দেখা যায় যেটা এখন কিছু আলামত দেখা যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায়। এগুলো দ্য আর অবজারভিং। এটা হয়তো বাংলাদেশে এই পর্যন্ত যেসব অর্জন আছে, খুব ভালো ভালো অর্জন আছে; সেই অর্জনগুলোকে ম্লান করতে পারে। সেটাই হলো তাদের ধারণা। যেটা আলোচনায় উঠে এসেছে। এটুকুই আমি বুঝতে পেরেছি।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, গওহর রিজভী, আওয়ামী লীগের ডা. দীপু মনি, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান রিয়াজ রহমান, বিকল্পধারার শমসের মবিন চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতী’র শারমিন মুরশিদ, সুজনের বদিউল আলম মজুমদারসহ বিভিন্ন নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।