এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : হাসপাতালের পোশাকেই দলের কার্যালয়ের সামনে হঠাৎ হাজির জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিজের গাড়িতে নয়, অন্য একটি গাড়িতে। গাড়ি থেকেই নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কথা বললেন। জানালেন তাকে চিকিৎসা করতে দেয়া হচ্ছে না, বিদেশ যেতে দেয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, আমাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। বৃহস্পতিবার দুপুরে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে একটি সভা চলছিল। এ সময় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে এরশাদ থামেন দলীয় কার্যালয়ের সামনে।
কিছু নেতাকর্মী ও সংবাদকর্মী তাকে ঘিরে ধরলে তিনি কথা বলতে শুরু করেন। এরশাদ নিয়মিত যাতায়াত করেন প্রাডো গাড়িতে। গতকাল আসেন কালো রংয়ের অন্য একটি গাড়িতে। সাংবাদিকরা এগিয়ে আসলে তিনি গাড়ির জানালা খুলে কথা বলতে চান। তার পরনে ছিল খাকি রংয়ের হাসপাতালের পোশাক।
এরশাদ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেও তার বক্তব্য ছিল নেতাকর্মীদের উদ্দেশে। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টির নেতাকর্মী ভাইবোনেরা। আমরা অনেক অত্যাচার-অবিচার সহ্য করেছি। অনেক অনেক অত্যাচার-অবিচারের মধ্য দিয়েও জাতীয় পার্টি বেঁচে আছে। আজ আমি বলতে এসেছি, আমায় দমিয়ে কেউ রাখতে পারবে না। আমরা এগিয়ে যাবোই যাবো। আমার একটু বয়স হয়েছে। চিকিৎসা করতে দেবে না, বাইরে যেতে দেবে না। কিন্তু আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমি মরি আর বাঁচি জাতীয় পার্টি তোমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে- এই আশা করি। ইনশাআল্লাহ আমি মরবো না। আল্লাহ আমাকে সেই মেহেরবানি করবেন। যাতে করে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব আবার আমি দিতে পারি। আমাদের কোনো ভয় নেই। জাতীয় পার্টি চিরকাল নির্বাচন করছে, এবারও করবে। আমাদের নতুন মহাসচিব এসেছেন। পুরনো মহাসচিবকে ভালোবাসতাম। কিন্তু নতুন মহাসচিবকে তোমাদের ভালোবাসতে হবে। তাকে গাইড করতে হবে। উনি নতুন, যাতে করে সঠিক পথে চলতে পারে। আমি বেঁচে আছি, বেঁচে থাকবো ইনশাআল্লাহ। আমি পার্টিকে ভালোবাসি।
কি করি নাই এ পার্টির জন্য। ২৭ বছর ঘুরে বেড়িয়েছি আমি একলা। আমরা লক্ষ লক্ষ মাইল হেঁটেছি। পার্টিকে বাঁচিয়ে রেখেছি। এখন নির্ভর করছে তোমাদের ওপর। পার্টি তোমরা ছাড়বে না। সবাই জাতীয় পার্টিতে থাকবে। আমাকে প্রতিশ্রুতি দাও কেউ পার্টি ছাড়বে না। তোমরা ভালো থেকো, আমি খেতে যাইতেছি বাসায়, আবার ফিরে যাবো। আমার একটু ব্লাড শর্টেজ আছে, কোনো অসুবিধা নেই। তোমরা আমার সন্তান, এই সব আমার সন্তান, তোমরা বেঁচে থাকলে বাপও বেঁচে থাকবে।
পরবর্তীতে বনানী কার্যালয়ে আয়োজিত ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবসে’র আলোচনায় এরশাদ আবার বাসা থেকে ফোনে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে কথা বলেন। এসময় তিনি বলেন, আমরা বড় কঠিন সময় পার করছি। সামনে আরো কঠিন সময় আসবে। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তিনশ’ আসন কেউ পায় না। তিনশ’ আসনে মনোনয়ন না পেলে নিরুৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। পার্টির জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। জাপা থাকবে, জাপা আছে। আমাদের সুদিন আসবেই। এদিকে বেশকয়েক দিন পর পার্টি চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে আসায় নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে স্লোগান দিতে থাকেন। তাকে কেনো চিকিৎসা করতে দেয়া হচ্ছে না- এটা নিয়ে স্লোগান তোলা হয়। এরশাদ পার্টি অফিসের সামনে থেকে প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় যান। পরে তিনি আবার সিএমএইচে ফিরে যান বলে পার্টি সূত্র জানিয়েছে।
নেতারা বললেন ভিন্ন কথা: এরশাদ তার চিকিৎসায় বাধা আসার কথা জানালেও তার ভাই ও পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের তা অস্বীকার করে বলেছেন, উন্নত চিকিৎসায় তার কোনো বাধা নেই। এরশাদের চিকিৎসা নিয়ে ধূম্রজালের কোনো সুযোগ নেই। গতকাল রাজধানীর বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করে। যেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন জাপার কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং অনুষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন নবনিযুক্ত মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা।
এরশাদের অসুস্থতা নিয়ে গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, এরশাদ সাহেব একজন বয়স্ক রাজনীতিবিদ, ওনার বয়স হয়েছে। এই বয়সে স্বাভাবিক কারণেই শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা যায়। ওনার সমস্যা হচ্ছে। তবে ডাক্তাররা যতটুকু মনে করেন দৌড়ঝাঁপ করা উচিত, তার চেয়ে বেশি করেন, যেটা ওনার শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। ডাক্তাররা ওনাকে বাধানিষেধ দেন-এখানে যেতে পারবেন না, ওখানে যেতে পারবেন না। বসে থাকতে হবে, ঘুমাতে হবে। এমন বাধা তো আমরা থাকলেও আমাদের বলতেন চিকিৎসকরা। আবার তিনি এও বলেন, তার চিকিৎসায় বাধা আছে বা তিনি ভীষণ খারাপ অবস্থার মধ্যে আছেন, তাও কিন্তু নয়। তবে ওনি যে সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন, তাও নয়। এদিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এরশাদের সিঙ্গাপুর যাওয়া নিয়ে দল উৎকণ্ঠিত নয় বলেও উল্লেখ করেন জাপা কো-চেয়ারম্যান। তিনি জানান, ডাক্তাররা যদি বলেন, এখানে উন্নত চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে, তাহলে কেন তাকে নিয়ে যাবো? তবে তারা যদি মনে করেন, চিকিৎসা তার যথেষ্ট নয়, ওনাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যেতে হবে।
এরশাদের ঠিক কি কি রোগ রয়েছে, তা জানতে চাইলে গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, অসুখের ব্যাপার হলো পারসোনাল ব্যাপার। অসুখের ইনফরমেশন দিতে আমি বাধ্য নই। এটা আমি দেবো না। এটা কোনো দেশে কোনো হসপিটালে চাইলেও পাবেন না। এরশাদের সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা, তিনি যতটুকু সুস্থ থাকার কথা, ততটুকু আছেন।
তবে সম্পূর্ণ সুস্থ এটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। তবে এরশাদ দলীয় সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট আছেন জানিয়ে জি এম কাদের বলেন, ওনার নির্দেশমতো পার্টি চলছে। পার্টি এখনো তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রাধীনে আছে। নির্বাচনের আগে কোনো মহলের নানা বিধিনিষেধ রয়েছে জানতে চাইলে এমন গুঞ্জনের জবাবও দেন এরশাদের ছোট ভাই কো-চেয়ারম্যান কাদের। তিনি বলেন, ক’দিন আগে দলে বড় রদবদল হয়েছে। তিনি দল পরিচালনা করছেন। তিনি নিয়ন্ত্রণে আছে, এটার কোনো কারণ নেই। এরকম একটা আশঙ্কা করতে পারেন, কারণ গতবার এমন একটা কথা রটেছিল।
এবার বিভ্রান্তির তেমন কোনো সুযোগ নেই। বিধিনিষেধ যদি থাকতো, তাহলে দলের রদবদল তো হলো, সেটা আর সম্ভব হতো না। এরশাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যেতে পারেন, তবে তা ১০ তারিখের আগে নয় বলে জানিয়েছিলেন নতুন মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তবে গতকাল তিনি বলেন, নমিনেশন পেপার প্রত্যাহার হচ্ছে ৯ তারিখে। আমরাই ওনাকে বলছি, স্যার ৯ তারিখের পরে যান। অসুবিধার তো তেমন কিছু নাই। পার্টির প্রধান দেশের বাইরে থাকলে তো আমাদেরও খারাপ লাগে। যুব সংহতির মহাসচিব ফখরুল আহসান শাহজাদা বলেন, প্রতিটি নির্বাচন আসলে এরশাদকে থাকতে হয় ‘সিএমএইচে না হয় বাসায় অবরুদ্ধ’। দেশে আজ গণতন্ত্র নেই। বাকশালী শাসন যেখানে কায়েম হচ্ছে। সেখানে সাংবাদিকরাও কথা বলতে পারছে না। এ অবস্থার আমরা অবসান চাই। তিনি এরশাদকে স্বৈরাচার বলা নিয়ে গর্ববোধ করেন। বলেন, এখন যা হচ্ছে তাহলে এরশাদকে কীভাবে এটা বলি।
আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন- পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য নূর-ই হাসনা লিলি চৌধুরী, সুনীল শুভ রায়, এস.এম ফয়সল চিশতী, উপদেষ্টা- অ্যাড. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া, ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু, যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, স্বেচ্ছাসেবক পার্টির সদস্য সচিব মো. বেলাল হোসেন, শ্রমিক পার্টির সভাপতি একেএম আশরাফুজ্জামান খান, ছাত্রসমাজের আহ্বায়ক মোড়ল জিয়া।