এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিএনপির রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার কথাই শেষ কথা। সংকটময় মুহূর্তে যে কোনো সিদ্ধান্তের জন্য বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর বিএনপির রাজনীতি যখন মুখ থুবড়ে পড়েছিল, নেতারা যখন ছন্নছাড়া, এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিলেন, তখন দলের প্রয়োজনে রাজনীতিতে আসেন আপাদমস্তক গৃহবধূ খালেদা জিয়া।
দলের প্রাথমিক সদস্যপদ দেয়ার পর তাকে করা হয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে পরিণত হন খালেদা জিয়া। দলের চেয়ারপারসনের পদ দেয়া হয় তাকে।
এর পরের সময়টি শুধুই সফলতার। নব্বই দশকে গণতন্ত্রের জন্য টানা কয়েক বছর রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন তিনি। কারাবরণও করতে হয়। ওই আন্দোলনে তার আপসহীন ভূমিকা সবাইকে চমকে দেয়।
গৃহবধূর তকমা পেছনে পেলে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পান খালেদা জিয়া। রাজনীতিতে আলাদা ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন তিনি। স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রাজনীতির কণ্টকাকীর্ণ পথে দৃঢ়তার সঙ্গে হাঁটতে থাকেন।
১৯৯১ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। এই সময়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় তার নেতৃত্বেই। এর পর থেকে দেশের জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯৯১ সাল থেকে বিএনপির প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের কলাকৌশল নির্ধারণ ও প্রচারে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। গত দুটি নির্বাচনে তাকে সহায়তা করেছেন তার বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনিও একাধিক মামলায় দণ্ডিত হয়ে বিদেশে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।
এমতাস্থায় খালেদা জিয়াকে ছাড়াই দলীয় মনোনয়ন ঠিক করেছে বিএনপি।
দুই মামলায় ১৭ বছর দণ্ডিত হওয়ায় খালেদা জিয়ার নির্বাচন করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। নির্বাচন কমিশন তার মনোনয়নের বৈধতা দেয়নি। আপিলেও প্রার্থিতা ফেরত পাননি।
এখন হাইকোর্টে আপিল করেছেন তার আইনজীবীরা। কোর্টই তার ভাগ্য নির্ধারণ করবেন।
এমতাবস্থায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেয়া ও তার মুক্তি নিয়ে ঘোর অমানিশায় দলের নেতাকর্মীরা। তার ভোটে অংশ নেয়া ও নির্বাচনী প্রচারে থাকা অনিশ্চিত ধরেই এগোচ্ছে বিএনপি।
খালেদা জিয়ার অবর্তমানে এবার ধানের শীষের প্রচারে নেতৃত্ব দেবেন কে, এটি নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরে রাজনীতির অলিগলিতে ও চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। এ নিয়ে বিএনপি নেতাদেরও কপালে ভাঁজ।
কারণ ভোটের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার একটি ‘ফেস ভ্যালু’ আছে। নির্বাচনী প্রচারে তার উপস্থিতি একটি ভিন্নমাত্রা যোগ করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে। তিনি যে এলাকায় নির্বাচনী প্রচারে যান, সেখানে জোয়ার সৃষ্টি হয়।
নেতাকর্মীরা প্রাণ ফিরে পান। তৃণমূল সব ভেদাভেদ ভুলে ধানের শীষের মোহনায় এক হয় খালেদা জিয়ার মুখপানে চেয়ে।
মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন, তারাও মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন খালেদা জিয়ার আশ্বাসে। তারা জানেন নেত্রী কথা দিলে কথা রাখেন।
কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বিএনপিকে একটি ভীরু রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে এগোতে হচ্ছে। দলের মনোনয়ন নিয়েও সৃষ্টি হয়েছে ক্ষোভ-অভিমানের।
দুই বৃহৎ রাজনৈতিক জোট এবার বিএনপির নির্বাচনী সঙ্গী। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে রয়েছে ৪টি দল। আর ২০-দলীয় জোটে ২৩ দল। তাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও অনেক মন কষাকষি হয়েছে।
সব মিলিয়ে বিএনপি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। এখনও বহু নেতাকর্মী কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকের নামে শয়ে শয়ে মামলা। এসব কারণে অনেক নেতাকর্মী ভোটের মাঠে থাকা তো দূরের কথা বাড়িতেই থাকতে পারছে না।
এই প্রতিকূল পরিবেশেও বিএনপি ভোটের মাঠে থাকার বিষয়ে প্রত্যয়ী। তারা যে কোনো মূল্যে ভোট করতে চায়। কিন্তু খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তারেক রহমানকে বিদেশে রেখে ভোটে কতটা সফল হবে বিএনপি। এটি এখন দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে কোটি টাকার প্রশ্ন।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অন্তত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিএনপির একটি অংশ মনে করছে এভাবে নির্বাচন করে খুব একটি লাভবান হওয়া যাবে না। অহেতুক আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি সরকারকে বৈধতা দিয়ে দিল। এ মত যাদের তাদের মধ্যে অনেকে এবার দলের মনোনয়ন ফরমই কেনেননি। আবার অনেকে মনোনয়ন পেয়েও ভোট করছেন না।
দলের আরেকটি অংশ মনে করছে, ভোটে যাওয়া ছাড়া বিএনপির সামনে বিকল্প পথ খোলা নেই। এক দশক নির্বাচনের বাইরে থাকা দলটি এবারও ভোটে না গেলে দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। নেতাকর্মীদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই ভোট করেই খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন বেগবান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আত্মপ্রত্যয়ী তারা।