এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : আসন্ন নির্বাচনে জনগণকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার সুযোগ না দিলে দেশে মহা সংকটের সৃষ্টি হবে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। সরকার ও নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে তিনি বলেন, এখনও সামনে সাত দিন সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে বিরোধী নেতাকর্মীদের হয়রানি গ্রেপ্তার বন্ধ করে, প্রচার-প্রচারণার সমান সুযোগ দিয়ে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন। তা না করে ভাঁওতাবাজির নির্বাচন করলে তা কেউ মেনে নেবে না। গতকাল সন্ধ্যায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলন থেকে তিনি ঢাকায় চার দিনের জনসভা ও গণমিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ ছাড়া, ২৭শে ডিসেম্বর বেলা ২টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে জনসভা করার ঘোষণা দেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা ও নেতাকর্মীদের হয়রানির লিখিত তথ্য তুলে ধরা হয়।
ড. কামাল হোসেনের পক্ষে এ লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন ঐক্যফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট জগলুল হায়দার আফ্রিক। পরে ড. কামাল বলেন, যে তথ্যগুলো দেয়া হয়েছে- তা নজিরবিহীন। আমি ৪০/৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের নির্বাচন দেখছি। কিন্তু কোনো দিন এমন চিত্র দেখিনি। পুলিশ কারো আদেশিত হয়ে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন মানে একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেখানে সরকারি দলের লোক থাকে। বিরোধী দলের লোক থাকে। যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে তাদের ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে যেতে হয়।
আবেদন করতে হয়। কিন্তু আর ৭ দিন পর ভোটের কি অবস্থা হবে তা আপনারা বুঝতেই পারেন। আমাদের যারা প্রার্থী তাদের পুলিশের বিরুদ্ধে কি ধরনের প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে তা নজিরবিহীন। তিনি বলেন, ৫০ বছরের অভিজ্ঞতা বলছে, এভাবে পরিকল্পিতভাবে পুলিশকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া। যারা ভোট চাইতে যাচ্ছে তাদের ওপর পুলিশ ও সরকারি দল মিলে আক্রমণ করছে। এটা আগে কখনো হয়নি। এমন আর দেখিনি। যেভাবে নির্বাচনী পরিবেশকে ধ্বংস করা হয়েছে এটা কল্পনাও করা যায় না। এটা যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়। না হলে সংবিধান লঙ্ঘন করার অপরাধ হবে। সংবিধানকে ভঙ্গ করার অপরাধ হবে। তিনি বলেন, হামলা দেখে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় আদেশ-নির্দেশের ভিত্তিতে এগুলো করা হচ্ছে। এটা সংবিধানকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম নির্বাচনের আগে কিছু তো হবেই, তবে এই অবস্থা দেখতে হবে তা কখনও ভাবিনি। ড. কামাল বলেন, নির্বাচনের আরো ৭ দিন আছে। এগুলো যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়। এই সংবাদ সম্মেলনের পর থেকেই যেন সরকার এগুলো বন্ধ করে। সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, মাথা ঠিক করেন। মাথা ঠান্ডা করেন। মাথা সুস্থ করেন। ইলেকশনে জিততে হবে। তাই বলে এভাবে ভাঁওতাবাজি করে না। এটাকে জেতা বলে না। মানুষের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করা, মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সংবিধান লঙ্ঘন লঙ্ঘন করা। এই নির্বাচনে যেটা করা হচ্ছে তা ইতিপূর্বের সকল স্বৈরাচারী সরকারকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই আপনাদেরকে ভালোভাবে বলছি, আর মাত্র সাত দিন আছে। এসব বন্ধ করুন। বন্ধ না হলে জনগণ নির্বাচন মেনে নেবে না।
এ সময় তিনি বলেন, ভোটবাক্স দখল করে নির্বাচনে জয়লাভ করলে জনগণ সরকারকে স্বীকৃতি দেবে না। স্বীকৃতি না দিলে এই বিজয়ের কোনো অর্থ হয় না। অর্থহীন বিজয়ের চেয়ে বিজয় না হওয়া অনেক ভালো। আমি অনুরোধ করবো- নির্বাচন হতে দেন। ড. কামাল বলেন, এদেশের মানুষ সচেতন। তারা চায় অবাধ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন। এই দেশের মানুষ বহু মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সুতরাং স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে স্বাধীনভাবে ভোট দেয়ার এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এটা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এই নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ৪৭ বছর পরে সংবাদ সম্মেলনে আজ কথা বলতে হবে এর চেয়ে আমার দুঃখের বিষয় নেই। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ড. কামাল বলেন, পুলিশের কর্মকাণ্ডে আমি অবাক হয়েছি। সংবিধান লেখার সময় পুলিশের ভূমিকা লেখা হয়েছিল ‘নিরপেক্ষ’। পুলিশ কোনো দলের কিংবা রাষ্ট্রের হবে না। তবে এখনকার পুলিশ কাউকে বিরোধীদলীয় মনে করলেই ধরে ফেলে, অর্থাৎ সংবিধানে যে নিরপেক্ষ শব্দটি লেখা আছে, তার ষোল আনা পরিপন্থি কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশ।
তিনি বলেন, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি কোনো ভোট হয়নি। এটা একটা আয়োজন ছিল। তারা বলেছিল, দ্রুত নির্বাচন দেবে। তবে সেই দ্রুত সময় আর আসেনি। যেটা হয়েছে তা হলো- নতুন করে ‘দ্রুত’ শব্দের অর্থ তৈরি করতে হবে। ‘দ্রুত’ মানে ৫ বছর। এ সময় তিনি বলেন, প্রহসন বন্ধ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করুন- তা না হলে দেশে সংকটময় পরিস্থিতি তৈরি হবে। তিনি বলেন, তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে দাবি করবেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। দয়া করে মিথ্যাচারের এ খেলা বন্ধ করুন। এটা স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থি। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে পুলিশকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া এবং পুলিশের সঙ্গে সরকারি দল মিলে ভোট চাওয়ার ঘটনা আমার ৫০ বছরের অভিজ্ঞতায় দেখিনি। বিরোধী প্রার্থীরা যারা ভোট চাইতে যাচ্ছে তাদের ওপর এরকম আক্রমণ আগে কখনো হয়নি। এবার যেভাবে ভোটের পরিবেশকে ধ্বংস করা হয়েছে এটা কল্পনা করাও যায় না। এগুলো যেন অবিলম্বে বন্ধ করা হয়। না হলে সংবিধান লঙ্ঘন করার অপরাধ হবে। সংবিধানকে ভঙ্গ করার অপরাধ হবে। যদি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুযোগ না দেয়া হয় তাহলে এই নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত দাবি করবে তাদের কোনোভাবেই নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। তখন মহা সংকট সৃষ্টি হবে। জনগণ দেশের ক্ষমতার মালিক। তাদের ভোট দিতে না দেয়া স্বাধীনতার ওপর আঘাত। এই আঘাত মেনে নেয়া যায় না।
ড. কামাল হোসেনের পক্ষে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে সারা দেশে ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা প্রতিনিয়ত বাধা ও মারধরের সম্মুখীন হচ্ছেন। ঐকফ্রন্ট প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শুক্রবার সকাল ১১টায় গ্রেপ্তার করা হয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনের প্রার্থী আবু সাঈদ মো. শাহাদত হোসাইনকে। এ পর্যন্ত ধানের শীষ প্রতীকের ১৬ জন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভুতুড়ে মামলায় আরো ২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড চাওয়া হয়। ইতিমধ্যে আফরোজা আব্বাস, রোমানা মাহমুদ টুকু, সাবিনা ইয়াসমিন ছবি, কনক চাঁপাসহ ৫ জন নারী প্রার্থীর ওপর নগ্ন হামলা করা হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৩টি নির্বাচনী এলাকায় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থিতা শূন্য হয়ে গেছে। ২০শে ডিসেম্বরও ১১ জনের প্রার্থিতা স্থগিত করেছেন কোর্ট। ১৬জন প্রার্থী কারাগারে। নির্বাচন কমিশন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আইন করে উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের ক্ষেত্রে পদত্যাগ করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিধান করেছে। অন্যদিকে উচ্চ আদালত একে একে তাদের প্রার্থিতা অবৈধ ঘোষণা করে চলেছেন। এতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচনের পূর্বেই নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে যেতে হচ্ছে এবং এর সুবিধা নিচ্ছেন ক্ষমতাসীনরা। প্রায় প্রতিদিন নানাভাবে ঐক্যফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল করা হচ্ছে।
যা ঐক্যফ্রন্টকে নির্বাচনের বাইরে ঠেলে দেয়ার শামিল। প্রাধান নির্বাচন কমিশনার যতই বলছেন, নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, মাঠে কিন্তু এর প্রমাণ মিলছে না। বরং মাঠের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাঠে ঐক্যফ্রন্টকে দাঁড়াতেই দেয়া হচ্ছে না। প্রশাসনও বৈরী আচরণ করছে। নানা জটিলতায় অর্ধশতাধিক আসনে ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী নেই। যেসব নির্বাচনী এলাকায় জাতীয় ঐকফ্রন্টের প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে, সেসব নির্বাচনী এলাকায় পুনঃতফসিলের দাবি জানাচ্ছি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- বিএনপি নাকি ব্যালট পেপার ছাপিয়েছে, এটা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা নয়তো? অন্যদিকে শুরু থেকেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীদের প্রচার কাজে প্রকাশ্যে বাধা দিচ্ছে সরকারি দলের সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রার্থীসহ নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর সশস্ত্র হামলা থামছেই না। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অবাধে গুলিবিদ্ধ করে আহত করা হচ্ছে তাদের। আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী গত বুধ ও বৃহস্পতিবার গায়েবি মামলা হয়েছে সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।
নির্বাচনী প্রচারে বাধা, হামলা, ভাঙচুরের মতো সহিংসতা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। পুলিশসহ প্রশাসনের ভূমিকা দেশবাসীকেও রীতিমতো অবাক করছে। তিনি বলেন, ঘটে যাওয়া চলমান পরিস্থিতি অকাট্য প্রমাণ করছে যে সবার জন্য সমান সুযোগ আজও তৈরি হয়নি। সৃষ্টি হয়নি বহু কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত অবাধ, সুষ্ঠু ও বাধাহীন ভোটদানের নিরাপদ পরিবেশ। বরং চলমান সহিংসতা বলে দিচ্ছে- সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন জনপ্রত্যাশিত সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির পথে নিজেরাই অন্তরায়। বিবেকের দায় থেকে ইতিমধ্যে একজন নির্বাচন কমিশনার সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ার বিষয়টি একাধিকার দেশবাসীর সামনে স্পষ্ট করেছেন। এতে আমাদের এতদিনের বক্তব্যের সত্যতা শতভাগ মিলে গেছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের দিন ইন্টারনেটের গতি কমানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যা হবে আত্মঘাতী। এটা ভোট কেন্দ্রে কোনো প্রকার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে তা রিটার্নিং অফিসার, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ, কিংবা নির্বাচন কমিশনের দৃষ্টিগোচরে দ্রুত ও সহজে আনার ক্ষেত্রে স্পষ্টতই বাধার সৃষ্টি করবে।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এখন পুলিশ। যেসব নির্বাচনী এলাকায় পুলিশ কর্মকর্তারা হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার করে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের নির্বাচনী এলাকা ছাড়া করেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবিলম্বে তাদের প্রত্যাহার করে সেখানে নিরপেক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।