এশিয়ান বাংলা, ঢাকা : ভোটের আগের রাত থেকেই কেন্দ্র পাহারা দিতে হবে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছু নেই, মানুষ একবারই মরে দুবার মরে না। ন্যায়ের জন্য, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে বুক সোজা করে দাঁড়ান। আমার হক আমি আদায় করে নেব। ভোট দেয়া আমার হক। আমার ভোট আমি দেব, কেউ কিছু বলতে পারবে না। মনে রাখবেন, সারা দেশে খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। আপনি একটা ভোট দিবেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি হবে।
আপনারা বাড়ির সবাইকে নিয়ে ভোট দিবেন। সেদিন আমরা কোনো বাধা মানব না। অনেক বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই সমাবেশে এসেছি। আপনারাও এসেছেন। এই বাধা-বিপত্তি পেরিয়েই আমাদের বিজয় অর্জন করতে হবে।
গতকাল নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার সোনাকান্দা স্টেডিয়ামের জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। ট্রাক দিয়ে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চে বিএনপি মহাসচিবসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ এবং নারায়ণগঞ্জের পাঁচটি আসনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীরা উপস্থিত ছিলেন।
সমাবেশস্থলে যাবার আগে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের গাড়িবহর সোনারগাঁয়ের কাঁচপুর এলাকায় আটকে দিতে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নেয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এছাড়া বন্দরের মদনপুরে রাস্তার ওপর বাঁশ ও কাঠ ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তা দিয়ে সমাবেশস্থলে নিয়ে যায়।
সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই নির্বাচনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে দেশের মানুষ অন্ধকারে থাকবে নাকি আলোর দিকে যাবে। মানুষ স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের অধীনে থাকবে নাকি গণতন্ত্রের দিকে যাবে। মানুষ পরাধীন হয়ে থাকবে নাকি স্বাধীন হয়ে থাকবে। তিনি সবাইকে সর্তক থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, ভোট দিয়ে ভোট গণনা করে লিখে নিয়ে তারপর ভোট কেন্দ্র ছাড়বেন। ওরা চুরি করতে ওস্তাদ। যেভাবে কুইক রেন্টাল চুরি করে। মেগা প্রকল্পে মেগা চুরি করে। ভোট চুরি করতেও ওরা ওস্তাদ। ওরা বলে বেড়াচ্ছে, আগের রাতেই নাকি ভোটের বাক্সভর্তি করে রাখবে। তাই আগের রাতেই পাহার বসাতে হবে।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অদ্ভুত নির্বাচন উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন কমিশনার বলেছেন দেশে নাকি গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। সুবাতাস কেমন- আমার ভাইয়েরা নির্বাচনী সভায় আসতে পারে না। পারমিশন নেয়ার পরেও মঞ্চ করতে পারে না। মাইক বাঁধতে দেয়া হয় না। রাস্তায় রাস্তায় আটকে দেয়া হয়। তবে এই নির্বাচনেই আমাদের জয়ী হতে হবে। কারণ জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে।
তিনি পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা নির্বাচনের দায়িত্বে আছেন। আপনারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপনারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করবেন। আপনারা জনগণের স্বার্থে থাকবেন। জনগণের বিরুদ্ধে যাবেন না।
নির্বাচন কমিশনকে ঠুটো জগন্নাথ উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কিচ্ছু করার নেই। কমিশনকে বলি, কোমর সোজা করে দাঁড়ান। সংবিধান, রাষ্ট্র আপনাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে, সেই দায়িত্ব আপনি পালন করুন। দেখতে হবে এই দেশে যেন নির্বাচন হয়, জনগণ যাতে তার মতামত প্রকাশ করতে পারে। তার ব্যবস্থা করুন। অন্যথায় পদত্যাগ করুন। না পারলে চলে যান।
বর্তমান নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের ১৪ জন প্রার্থীকে জেলখানায় পাঠিয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে তফসিল ঘোষণার পর কারাগারে নেয়া হয়েছে। জামিন দেয়া হচ্ছে না। অথচ প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, তফসিল ঘোষণার পরে আর গ্রেপ্তার হবে না। এসময় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, কি বলব আপনাকে ‘সত্যবাদী’। তখন উপস্থিত জনসাধারণ ‘মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী’ বলে স্লোগান দিতে থাকে।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে। কিসের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, একদল মঞ্চ করে হাজার হাজার লোক নিয়ে পতাকা উড়িয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে গিয়ে সভা করছে। আর আমাদের সভা করতে দেয়া হয় না।
তিনি বলেন, গত দুদিন আগে কুমিল্লা গিয়েছিলাম। কুমিল্লায় মনিরুল হক চৌধুরীসহ তিন প্রার্থী কারাগারে আছেন। মনিরুলের চৌধুরীর মেয়ে কেঁদে কেঁদে সবার কাছে গিয়েছে। বলেছে, আমার বাবা, চাচারা কারাগারে। আপনারা আসুন, প্রতিবাদ করুণ। লক্ষ মানুষ সেদিন সভায় এসেছিল। এভাবেই সারাদেশে প্রতিটি জায়গায় মানুষ জেগে উঠছে। যতই মানুষ জেগে উঠছে। সরকার ততই ভয়ে পেয়ে আরও বেশি অত্যাচার-নির্যাতন করছে। ফখরুল বলেন, মানুষ কখন নির্যাতন করে, যখন সে একা হয়ে যায়. যখন তার পাশে কেউ থাকে না।
ফখরুল বলেন, গত ১০ বছর ধরে স্বৈরাচারী সরকার আমাদের অসংখ্য ভাইকে হত্যা করেছে। অসংখ্য ভাইকে গুম করেছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনা কারণে কারাগারে নিয়েছে। গণতন্ত্রের মাতা যিনি সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। গত ১০ মাস ধরে তিনি অন্ধকার কারাগারে শুধু প্রহর গুনছেন কবে বাংলাদেশে স্বাধীনতার পতাকা উড়বে, গণতন্ত্রের পতাকা উড়বে। দুই সপ্তাহ আগে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি অত্যন্ত অসুস্থ, তিনি হাঁটতে পারেন না। হুইল চেয়ারে চলতে হয়। কিন্তু তার মুখে কোনো মলিনতা দেখিনি। তিনি আমাকে দেখেই বললেন- তোমরা সবাই ভালো আছো। ঐক্যবদ্ধ থাকো। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে মধ্যদিয়ে গণতন্ত্রকে তোমরা মুক্ত করো, তাহলেই আমার মুখে হাসি ফুটবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম গণতন্ত্রের জন্য। সেই গণতন্ত্রকে আজ তারা উধাও করে দিয়েছে। এখন এক ব্যক্তির আর এক দলের শাসন। খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার আগে বলেছিলেন, আমি কারাগার ভয় পাই না। আমি আজীবন সংগ্রাম করেছি গণতন্ত্রের জন্য। আজ বাংলাদেশকে মুক্ত করতে তোমরা জাতীয় ঐক্য তৈরি করো। আমরা জাতীয় ঐক্যফন্ট গঠন করেছি। এসময় তিনি এসএম আকরামসহ নারায়ণগঞ্জের ধানের শীষ প্রতীকে সকল প্রার্থীর জন্য ভোট চান।
যুবকদের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা যদি সরকারে যাই যুবকদের চাকরির ব্যবস্থা করব। কল কারখানা তৈরি করব। যতদিন চাকরি দিতে পারব না তাদের বেতন ভাতার ব্যবস্থা করব। আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, খিস্ট্রান ভাইদের জন্য মন্ত্রণালয় তৈরি করব। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করব। পরিষ্কার করে বলতে চাই, এই দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপরে হাত দেয়া যাবে না। দাঁড়ি, টুপি পরলেই জঙ্গি- বলা চলবে না। হিন্দু ভাইদের ওপর অত্যাচার করা চলবে না। খ্রিস্টান ভাইদের চার্চ নষ্ট করা চলবে না। বৌদ্ধ ভাইদের মন্দিরকে বিনষ্ট করা যাবে না। এই দেশ সব ধর্মের মানুষের দেশ।
সমাবেশে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না জনসাধারণের উদ্দেশ্যে বলেছেন, সবাইকে ভোট দিতে হবে। সকালে ভোট দিয়ে তারপর কেন্দ্রে থাকতে হবে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পান্ডারা বলবে, ভোট দিয়েছো, আবার কি, বাড়ি যাও। আপনারা বলবেন ভোট যেহেতু দিয়েছি তা গুণে বাড়িতে যাব। মা-বোনসহ সবাইকে বলেন ৩০ তারিখ লড়াইয়ের দিন। সহ্য অনেক করেছি। ১০ বছর যাবৎ সহ্য করেছি। সহ্য ২৯ তারিখ পর্যন্ত করবো। ৩০ তারিখে সহ্য করব না। ভোট দেব তারপর ভোট গুনে নেব। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সারা দেশে গত ১০ বছরে লুটের বাজার হয়েছে। লক্ষ-কোটি টাকা চুরি হয়েছে। চারটি বড় বড় ব্যাংক থেকে লুট করে টাকা খেয়েছে। শেয়ার বাজার লুট করার ফলে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করেছে। কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। কত মানুষের জীবন নিয়ে গেছে, গুম হয়েছে, খুন হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের ত্বকি হত্যার বিচার হয়নি।
তিনি বলেন, এই সভা করার জন্য ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি কেন। সারা মাঠে মাইক থাকার কথা ছিল। মঞ্চ থাকার কথা ছিল। এত কিছু করেও কী জনগণকে সভায় আসা থেকে বন্ধ করা গেছে।
মান্না বলেন, সারাদেশে যেখানেই গেছি ওরা বাধা দিয়েছে। মাইক কেড়ে নিয়েছে। মঞ্চ করতে দেয়নি। প্রচার করতে দেয়নি। হামলা করেছে, মামলা করেছে। তবু জনগণের কণ্ঠ বন্ধ করতে পারেনি। গণস্বাস্থকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এবারের নির্বাচন ১৯৭০ সালের নির্বাচন থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এবারের নির্বাচন জাতির বেঁচে থাকার নির্বাচন। এবারের নির্বাচন নির্ধারণ করবে এদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচবে না পরাধীনভাবে। আজকে শাসক শ্রেণির হৃদস্পন্দন যেমন বেড়েছে তেমনি তাদের অত্যাচার বাড়ছে। আপনারা দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কেন ক্ষমা চাইলেন? ক্ষমা চেয়েছেন কারণ উনার সরকার হাজার হাজার মানুষকে বিনা বিচারে হত্যা করেছে। এটা কোনো স্বাধীন দেশের লক্ষণ নয়। আজ হাজার হাজার মানুষকে মিথ্যা, গায়বী মামলায় বন্দি করেছেন। এটা থেকে জনগণ আজকে মুক্তি চায়। জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। আমাদের কাছে একটি মাত্র পথ আছে। যতই অত্যাচার হোক আগামী ৩০ তারিখে আপনি এবং আপনার বাড়ির প্রত্যেককে নিয়ে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের জয় সুনিশ্চিত।
নারায়ণগঞ্জ মহানহগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এটিএম কামালের সভাপতিত্বে এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আল ইউসুফ খান টিপুর সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা তৈমূর আলম খন্দকার, নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে বিএনপির প্রার্থী ও জেলা বিএনপির সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনির, নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের প্রার্থী নজরুল ইসলাম আজাদ, নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনের ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী মুফতি মনির হোসেন কাসেমী, নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনে ঐক্যফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী এসএম আকরাম, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মামুন মাহমুদ, গণফোরাম জেলার আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন চুন্নু, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সভাপতি সাঈদ আহমেদসহ কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাকর্মীবৃন্দ।